বেণীসংহার

বাইরে এসে দু’জনের কিছুক্ষণ নিম্নস্বরে কথা হলো; তারপর ব্যোমকেশ বিষতি দুটো নিয়ে নীচে নেমে গেল‌, রাখালবাবু তেতলায় উঠে গেলেন। ওপরে কনস্টেবল টুলের ওপর বসেছিল‌, উঠে দাঁড়াল।

চাবি দিয়ে ঘরের দোর খুলে রাখালবাবু ঘরে প্রবেশ করলেন‌, কয়েকবার এদিক ওদিক ঘুরলেন। তারপর দোরের বাইরে ফিরে এসে দেখলেন‌, মেদিনী ক্লান্তভাবে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে বলল্লেন—’মেদিনী‌, তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি তাই ডেকেছি।’

মেদিনী ব্যায়ত বিহ্বল চোখে চাইল‌, তারপর চোখের ওপর আচল চাপা দিল। রাখালবাবু বললেন-বিলো দেখি সেদিন সকালে তুমি যখন তোমার স্বামীর মৃতদেহ প্রথম দেখলে তখন সে কি চিৎ হয়ে শুয়েছিল?’

অবরুদ্ধ উত্তর এল–’জি‌, হাঁ।’

রাখালবাবু তাড়াতাড়ি বললেন—’আচ্ছা আচ্ছা‌, ও কথা থাক। এবার একবার ঘরের মধ্যে এসো।’

মেদিনী চোখের জল মুছে থমথমে মুখ নিয়ে ঘরের মধ্যে এল। রাখালবাবু চারিদিকে হাত ঘুরিয়ে বললেন-‘ঘরটা ভাল করে দেখা। তুমি আগে অনেকবার দেখেছি। কোথাও কোনো তফাত বুঝতে পারছ?’

মেদিনী বলল–’খাটের ওপর বিছানা নেই।’

‘তাছাড়া আর কিছু?’

মেদিনী চারিদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা নাড়ল—’আর কোনো তফাত বুঝতে পারছি না।’

‘হুঁ। আচ্ছা হয়েছে‌, এবার নীচে চল।’

মেদিনীকে নিয়ে রাখালবাবু নীচে নেমে গেলেন। মেদিনী নিজের ঘরে চলে গেল। রাখালবাবু ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে দেখলেন ব্যোমকেশ একটা চেয়ারে অঙ্গ এলিয়ে দিয়ে সিগারেট টানছে। দু’জনের চোখাচোখি হলো। ব্যোমকেশ বাঁকা হেসে ঊর্ধ্বদিকে ধোঁয়া ছাড়ল‌, তারপর খাড়া হয়ে বসে বলল–’শুভকাৰ্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে। রাখাল‌, এবার আমি বাড়ি ফিরব। তোমার কতদূর?’

রাখাল বললেন–‘গঙ্গাধর ঘোষালকে দর্শন করবেন না?’

‘ওহো তাই তো‌, গঙ্গাধরকে দর্শন করা হলো না। আজ থাক‌, সন্ধ্যে হয়ে গেছে‌, তিনি হয়তো ভুমানন্দে আছেন। কাল সকালে তাঁকে দর্শন করা যাবে।’ ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল‌, পকেট থেকে নিখিলের চিঠিগুলি নিয়ে রাখালবাবুর হাতে দিয়ে বলল–’এগুলোতে মেয়েলি আঙুলের ছাপ আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখো। আজ চলি।’

‘চলুন‌, আমিও যাই। বিষতিগুলো পরীক্ষা করতে হবে।’

পরদিন বেলা ন’টার সময় ব্যোমকেশ বেণীমাধবের বাড়িতে গিয়ে দেখল‌, রাখালবাবু সদর বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিখিল এবং সানতের সঙ্গে কথা বলছেন। ব্যোমকেশ যেতেই তিনি বললেন—’শুনেছেন ব্যোমকেশদা‌, মেদিনীর ঘর থেকে একটা বাক্স চুরি গেছে‌, টয়লেটের বাক্স।’

ব্যোমকেশ ভুরু উঁচু করে বলল-টয়লেট-বক্স। সে কি‌, কি করে চুরি গেল?’

‘তা ঠিক বলতে পারছি না। তবে কাল সন্ধ্যেবেলা মেদিনীকে আমি তেতলায় ডেকেছিলাম, ওর ঘর খোলা ছিল, সেই সময় হয়তো কেউ সরিয়েছে। তাই এদের জিজ্ঞেস করছিলাম। এরা কিছু জানেন কিনা। ’

সনৎ বলল—’আমি কি করে জানব বলুন। মেদিনীর ঘরের মধ্যে কখনো পদার্পণ করিনি, কোথায় কী আছে কোখেকে জানব?

নিখিল বলল—’দোহাই দারোগীবাবু, আমি টয়লেট-বক্স চুরি করিনি। আমার ঘরে চুল বেঁধে টিপ পরার মানুষ নেই।’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে প্রশ্ন করল—’মকরন্দকে জেরা করেছিলে?’

‘করেছিলাম। তাদের ফ্ল্যাট আবার খানাতল্লাশ করেছিলাম, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না।’

‘এদের ঘর?’

‘এইবার করব।’ রাখালবাবু একজন জমাদারকে এবং সাব-ইন্সপেক্টরদের ডেকে বললেন—’তোমরা এঁদের ঘর দুটো আবার ভাল করে খানাতল্লাশ কর, মেদিনীর চুল বাঁধার বাক্সটা পাও কিনা দেখা। আমরা দোতলায় গঙ্গাধর বাবুর ফ্ল্যাটে যাচ্ছি।’

সনৎ অপ্ৰসন্ন মুখে বলল-‘করুন করুন, যত ইচ্ছে খানাতল্লাশ করুন, কিন্তু আমার দামী ক্যামেরাগুলো ভাঙবেন না। ‘

ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু ওপরে উঠে গেলেন।

দোতলায় উঠে তাঁরা দেখলেন বারান্দার অপর প্রান্তে গঙ্গাধরের ফ্ল্যাটে সদর দরজা খুলে তার মেয়ে ঝিল্লী বেরিয়ে এল, দরজা ভেজিয়ে দিয়ে দু’পা এসে তাদের দেখে সংকুচিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাখালবাবু তার কাছে এসে ব্যোমকেশকে বললেন—’এর নাম ঝিল্লী, গঙ্গাধরবাবুর মেয়ে। —তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?’

ঝিল্লী সলজ্জ অস্ফুটম্বরে বলল—’মামীমা ডেকে পাঠিয়েছেন।’

ব্যোমকেশ ঝিল্লীর সংকোচনম্র কমনীয় মুখের পানে চেয়ে হাসল—’আমাদের দেখে এত লজ্জা কিসের? আমরা বাঘ-ভালুক নয়, কামড়ে দেব না।’

ঝিল্লী একটু হেসে চোখ তুলল। ব্যোমকেশ দেখল চোখ দুটি সুন্দর এবং বুদ্ধিদীপ্ত। রাখালবাবু পরিচয় দিলেন—’ইনিই বোমকেশ বক্সী।’

ঝিল্লীর চোখে উৎসুক আলো ফুটে উঠল, তারপর আস্তে আস্তে তার মুখের ওপর অরুণাভা ছড়িয়ে পড়ল। সে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করছে দেখে ব্যোমকেশ বলল—’ঝিল্লী, একটু দাঁড়াও, তোমার কাছে কিছু জানবার আছে।’

ঝিল্লী দাঁড়াল, কিন্তু ব্যোমকেশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রইল। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল—‘লাবণির সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল?

একটু দ্বিধার পর ঝিল্লী ঘাড় নাড়ল। ‘সে তোমাকে নিজের মনের কথা বলত, তুমি তাকে নিজের মনের কথা বলতে। কেমন?’

ঝিল্লী উত্তর দিল না, সতর্কভাবে অপেক্ষা করে রইল।

‘লাব্বণি নিশ্চয় তোমাকে বলেছিল। সে তার নাচের মাস্টার পরাগ লাহাকে ভালবাসে।’ ঝিল্লী ঘাড় নীচু করে আস্ফুটস্বরে বলল—’বলেছিল।’

‘সে পালিয়ে গিয়ে পরাগকে বিয়ে করবে বলেছিল? ঝিল্লী উৎফুল্ল চোখ তুলল—‘লাবণি ওকে বিয়ে করেছে!’

0 Shares