বেণীসংহার

‘হ্যাঁ। তুমি দেখছি জানতে না।’

‘না।‘

‘কিন্তু জানতে পেরে খুব খুশি হয়েছ।’

ঝিল্লী হেসে ফেলল।

ঝিল্লীকে ছেড়ে গঙ্গাধরের দোরের দিকে যেতে যেতে রাখালবাবু খাটো গলায় বললেন—’আপনার মন বিচিত্র কুটিল পথে চলেছে, কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি।’

ব্যোমকেশ মৃদু হাসল। রাখালবাবু গঙ্গাধরের দোরে টোকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে কড়া আওয়াজ এল—’কে? ভেতরে এসো।’

দু’জনে ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরের মাঝখানে গোল টেবিল‌, তার সামনে চেয়ারে বসে গঙ্গাধর তাস নিয়ে সলিটেয়ার খেলছিল‌, রাখালবাবুর দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বলল—’আবার কি চাই?’

গঙ্গাধরের ভাবভঙ্গী এখন অন্যরকম। নিজের টাকাকড়ি উড়িয়ে শ্বশুরের গলগ্রহ হবার পর সে কচ্ছপের মত হাত-পা গুটিয়ে নিয়েছিল‌, কিন্তু শ্বশুরের মৃত্যুর পর হালের আইন অনুযায়ী সে অর্ধেক রাজত্র পাবে এই অনিবাৰ্য সম্ভাবনার ফলে সে আবার নিজ মূর্তি ধারণ করেছে‌, তার আচার-আচরণে বনেদী বড় মানুষের মজ্জাগত আত্মম্ভরিতা আবার ফুটে উঠেছে।

তার কথা বলার ভঙ্গীতে ব্যোমকেশের মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল‌, তারপর রাখালবাবু যখন বললেন-ইনি আমার সহকারী শ্ৰীব্যোমকেশ বক্সী। তখন গঙ্গাধর উদ্ধতকণ্ঠে বলে উঠল—’তাতে কী হয়েছে? So what?’

ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠল‌, সে গঙ্গাধরের মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল–’আপনার নাম গঙ্গাধর ঘোষাল‌, কয়েক বছর আগে আপনি রেস-কোর্সের এক জকিকে ঘুষ খাওয়াবার চেষ্টা করার জন্যে আইনের হাতে পড়েছিলেন?’

গঙ্গাধর আরক্ত চোখে গর্জে উঠল–’তাতে আপনার কি?’

ব্যোমকেশ আঙুল তুলে বলল–’আপনি দাগী আসামী‌, আপনাকে খুনের সন্দেহে গ্রেপ্তার করা যায়। আপনার শ্বশুর উইল দস্তখত করার আগে রাত্রে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। কে তাঁকে খুন করেছে?’

বেগবান ঘোড়া হোঁচট লেগে যেন ডিগবাজি খেয়ে পড়ল। গঙ্গাধরের দম্ভস্ফীত মুখ তুবড়ে গেল‌, সে ভীতস্বরে বলল–’আমি কি জানি! আমি কি জানি।’

ব্যোমকেশ এবার একটু ঠাণ্ডা হলো‌, বলল–’বেণীমাধববাবুকে খুন করার স্বাৰ্থ আপনারও আছে‌, অজয়বাবুরও আছে; কিন্তু আপনি জামাতা‌, দশম গ্রহ।’

উত্তরে গঙ্গাধর দু’বার কথা বলবার জন্যে মুখ খুলল‌, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। ব্যোমকেশ তখন সহজ সুরে বলল–’আপনার মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলছে‌, বেশি তেজ দেখাবেন না।‘

এই সময় গায়ত্রী ভিতর দিক থেকে ঘরে প্রবেশ করল। আচলটা কোমরে জড়ানো‌, চোখে তীব্র দৃষ্টি‌, যুদ্ধং দেহি ভাব। সে একটা চেয়ারে বসে ব্যোমকেশকে কড়া সুরে বলল–’কি জানতে চান আমাকে বলুন।’

ব্যোমকেশ গায়ত্রীকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল—’আপনি বেণীমাধবাবুর মেয়ে গায়ত্রী দেবী। আপনাকেও কিছু প্রশ্ন আছে।–আপনার বাবা উইল সই করবার আগেই কেউ তাঁকে খুন করেছে। কিন্তু তাঁর আগের কোনো উইল আছে কিনা। আপনি জানেন?’

এতক্ষণে গঙ্গাধর কতকটা ধাতস্থ হয়েছে‌, সে বলে উঠল—’আমার শ্বশুর ইনটেসটেটু মারা গেছেন।‘

গায়ত্রী অমনি ধমক দিয়ে উঠল—’তুমি চুপ করো। —আমার বাবার অন্য কোনো উইল নেই। তিনি যা রেখে গেছেন নতুন আইনের জোরে তার অর্ধেক আমি পাব।’

‘বেণীমাধববাবু বিষয়ী লোক ছিলেন‌, এই বয়স পর্যন্ত তিনি উইল করেননি এ কি সম্ভব? হয়তো পুরনো উইল বেরুবে‌, যাতে তিনি অন্য কাউকে যথাসর্বস্ব দিয়ে গেছেন। হয়তো আপনার জন্য মাসহারা বরাদ্দ করে বাকি সব টাকা অজয়বাবুকে দিয়ে গেছেন।’

ক্রুদ্ধ উত্তেজনায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে গায়ত্রী প্রায় চীৎকার করে উঠল—’না না না‌, বাবা কখনো আমাকে বঞ্চিত করবেন না। তিনি দাদার চেয়ে আমাকে ঢের বেশি ভালবাসতেন।’

‘বসুন বসুন। আমি বলছি না যে‌, বেণীমাধববাবুর অন্য উইল আছেই। কিন্তু তিনি ভাগনেদেরও ভালবাসতেন‌, বাড়িতে এনে রেখেছিলেন; তাদের কি কিছুই দিয়ে যাননি?’

গায়ত্রী আবার চেয়ারে বসে বলল—‘ওরা বাবার আসল ভাগনে নয়‌, মাসতুত বোনের ছেলে। সনতের বাপ দুশ্চরিত্র ছিল‌, স্ত্রীকে খুন করে ফাঁসি যায়; নিখিলের বাপ সার্কাসের পেশাদার ক্লাউন ছিল। ওদের কেন বাবা টাকা দিয়ে যাবেন?’

‘আচ্ছা‌, ও কথা যাক। বলুন দেখি আপনার বাড়িতে কটা বর্ষাতি আছে।’

গায়ত্রী হঠাৎ যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল‌, কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল-দুটো আছে। একটা ওঁরা‌, একটা ঝিল্লীর।’

‘ও দুটো বার করে দিন‌, আমরা নিয়ে যাব।’

‘নিয়ে যাবেন! কেন?’

‘দরকার আছে। দুচার দিন পরে ফেরত পাবেন।’

গায়ত্রী আবার কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ উঠে চলে গেল‌, বলল–’কি দরকার জানি না। এনে দিচ্ছি।’

নীচে নেমে এসে রাখালবাবু ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করলেন–‘এবার?’

ব্যোমকেশ বলল—’চল আমার বাড়ি। নিভৃতে পরামর্শ করা যাক। একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে।‘

‘চলুন।’

বাড়িতে এসে ব্যোমকেশ চায়ের ফরমাস দিল। সত্যবতী চা এবং আলুর চাপ রেখে গেল। অতঃপর পানাহার এবং সিগারেট সহযোগে পরামর্শ শুরু হলো।

এক ঘন্টা পরে রাখালবাবু বললেন—’বেশ‌, এই কথা রইল। পুলিস ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনার রাহা খরচ ইত্যাদি দেওয়া হবে‌, আমি তার ব্যবস্থা করব। আজ বিকেলে পাকা খবর পাবেন।’

রাখালবাবু চলে যাবার পর সত্যবতী। ঘরে ঢুকল‌, ব্যোমকেশের চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসুক স্বরে বলল-‘হ্যাঁ গা‌, কী তোমাদের এত ষড়যন্ত্র হচ্ছে?’

ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়িয়ে আলস্য ভাঙল।–’আমাকে বোধহয় কয়েক দিনের জন্যে বাইরে যেতে হবে।’

‘কোথায় যাবে?’

‘তা কি জানি?’

‘তুমি জানো না তা কি কখনো হয়। নিশ্চয় জানো।’

0 Shares