বেণীসংহার

ব্যোমকেশ সত্যবতীর কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বলল—’বেশ‌, জানি কিন্তু বলব না।’

সত্যবতী রাগ করে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

বিকেল চারটের সময় রাখালবাবুর ফোন এল–’সব ঠিক। আপনি একটা সুটকেস নিয়ে সটান থানায় চলে আসুন।’

ব্যোমকেশের অনুপস্থিতিকালে বেণীমাধবের বাড়ির কর্মসূচী আগের মতাই বলবৎ রইল। কারুর বাইরে যাবার হুকুম নেই। একজন সাব-ইন্সপেক্টর‌, একজন জমাদার এবং চারজন কনস্টেবল হামোহাল মোতায়েন রইল। রাখালবাবু দুবেলা এসে পরিদর্শন করে যেতে লাগলেন। বেণীমাধবের মৃত্যু সম্বন্ধে নতুন কোনো তথ্য আবিষ্কৃত হলো না। মেদিনীর সাজের বাক্সটা অদৃশ্য হয়েছিল‌, অদৃশ্যই রয়ে গেল।

একদিন লাব্রণি তার স্বামীকে নিয়ে বাপ-মা’র সঙ্গে দেখা করতে এল। রাখালবাবু তাদের দেখা করতে দিলেন। বন্ধ দরজার অন্তরালে অজয়-পরিবার কীভাবে মেয়ে-জামাইয়ের সংবর্ধনা করল তা জানা গেল না। লাবণিরা যখন বেরিয়ে এল তখন লাবণির মুখে হাসি চোখে জল। বারান্দায় ঝিল্লীর সঙ্গে লাবণির দেখা হলো; দুই বোন পরস্পর গলা জড়িয়ে চুমু খেল‌, তারপর হাত ধরাধরি করে নীচে নেমে এল। নীচের বারান্দায় নিখিল ছিল‌, সে নব দম্পতিকে দেখে হো হো করে হেসে বলল,–’এই যে পলাতক আর পলাতক! দু’জনে মিলে খুব নাচছ তো?’

পরাগ কপট বিষণ্ণতায় ত্ৰিয়মাণ মুখভঙ্গী করে বলল—’দু’জনে মিলে নাচা আর হচ্ছে কই? এখন আমি নাচছি‌, লাবণি নাচাচ্ছে।’

লাবণিরা চলে যাবার পর নিখিল ঝিল্লীকে বলল—‘কী‌, তুমি আর দেরি করছ‌, কেন? একজন তো নাচিয়েকে নিয়ে কেটে পড়ল‌, এবার তুমি একটা গাইয়েকে নিয়ে কেটে পড়।’

ঝিল্লী ভুরু বেঁকিয়ে নিখিলের পানে তাকাল–’আমি কেটে পড়ব না। কিন্তু তোমার খবর কি? যে তোমাকে চিঠি লেখে তাকে ধরতে পারলে?’

নিখিল বলল—’ধরিনি এখনো কিন্তু আর বেশি দেরি নেই। ব্যোমকেশবাবু বলেছেন। শীগগির ধরে দেবেন। যেই ধরব অমনি পটাস করে বিয়ে করে ফেলব। আমার সঙ্গে চালাকি নয়।’

‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।’ মুচকি হেসে ঝিল্লী ওপরে চলে গেল।

পাঁচ দিন পরে ব্যোমকেশ ফিরে এল‌, তার সঙ্গে একটি মানুষ। নিম্নশ্রেণীর পশ্চিমা যুবক। ব্যোমকেশ যুবককে নিয়ে সোজা থানায় উপস্থিত হলো‌, রাখালবাবুর সঙ্গে কথা বলল। তারপর যুবককে রাখালবাবুর জিন্মায় রেখে বাড়ি গেল–রাখালবাবুকে বলে গেল–’আজ বিকেল চারটের সময় বেণীমাধবের ড্রয়িং রুমে থিয়েটার বসবে‌, তুমি হবে তার স্টেজ ম্যানেজার।’

বিকেল চারটের সময় ব্যোমকেশ বেণীমাধবের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখল‌, ড্রয়িং রুমে বাড়ির নজন লোক উপস্থিত আছে; অজয় আরতি মকরন্দ্র একটা সোফায় বসেছে‌, অন্য সোফায় বসেছে গঙ্গাধর গায়ত্রী আর ঝিল্লী। সনৎ আর নিখিল দুটো চেয়ারে দূরে দূরে বসেছে; আর মেদিনী মেঝের ওপর দেয়ালে ঠেস দিয়ে উদাসভাবে বসে আছে। সকলের মুখেই বিরক্তি ও অবসাদের ব্যঞ্জনা। ড্রয়িংরুমের দোরে ও বারান্দায় পুলিস গিজগিজ করছে। রাখালবাবু একটা ছোট সুটকেস হাতে নিয়ে অধীরভাবে বারান্দায় পায়চারি করছেন।

ব্যোমকেশ পৌঁছুঁতেই রাখালবাবু তাকে বললেন—’সব তৈরি‌, এবার তবে আরম্ভ করা যাক।’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল–’হিম্মৎলাল?’

রাখালবাবু বললেন–‘তাকে লুকিয়ে রেখেছি। যথাসময়ে সে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করবে।’

‘বেশ‌, এসো তাহলে। তোমার হাতে ওটা–? ও বুঝেছি।’

রাখালবাবু ব্যোমকেশকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলেন। সকলে নড়েচড়ে বসল‌, মকরন্দর মুখের ভ্রূকুটি গভীরতর হলো। রাখালবাবু মাঝখানের নীচু টেবিলটাকে এক পাশে টেনে এনে দুটো হাল্কা চেয়ার তার সামনে রাখলেন; হাতের সুটকেস টেবিলের ওপর রেখে ব্যোমকেশকে বললেন–‘বসুন।’ নিজে সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ব্যোমকেশ হাসিমুখে একবার সকলের মুখের দিকে তাকাল‌, বলল—’আপনারা শুনে সুখী হবেন বেণীমাধববাবুর হত্যাকারী কে তা আমরা জানতে পেরেছি‌, আততায়ীর বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণও পেয়েছি। আসামী এই ঘরেই আছে‌, এখনি তার পরিচয় পাবেন।’

সকলে সন্দেহভরা চোখে পরস্পর তাকাতে লাগল; বেশি দৃষ্টি পড়ল গঙ্গাধরের ওপর। ব্যোমকেশ শান্ত স্বরে বলে চলল—’আমরা গোড়াতেই একটা ভুল করেছিলাম‌, ভেবেছিলাম বেণীমাধববাবুই আসামীর প্রধান লক্ষ্য। ভুলটা অস্বাভাবিক নয়; বেণীমাধববাবু বড় মানুষ ছিলেন‌, তিনি এমন উইল করতে যাচ্ছিলেন যাতে তাঁর উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা ছিল; মেঘরাজ ছিল বেণীমাধবের দ্বাররক্ষী‌, বেণীমাধবকে যে ব্যক্তি মারতে চায় সে মেঘরাজকে না মেরে ঘরে ঢুকতে পারবে না। তাই তাকে মেরেছে। মেঘরাজের মত লোক যে হত্যাকারীর প্রধান লক্ষ্য হতে পারে তা ভাবাই যায় না।

‘আমি একদিন বেণীমাধববাবুর ঘরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম তাঁর ক্ষুর রয়েছে; সাবেক কালের লম্বা ক্ষুর‌, যে-খুর দিয়ে মেঘরাজ তাঁর দাড়ি কামিয়ে দিত। ক্ষুরটা খাপ থেকে বের করে পরীক্ষা করলাম‌, তাতে কোথাও একটিও আঙুলের ছাপ নেই; কে যেন খুব সাবধানে ক্ষুরটি মুছে খাপের মধ্যে রেখেছে। কিন্তু কেন? স্বাভাবিক অবস্থায় অন্তত মেঘরাজের আঙুলের ছাপ তাতে থাকা উচিত।

‘সন্দেহ হলো। সেই ক্ষুর দিয়ে আমি নিজে দাড়ি কামাতে গিয়ে দেখলাম ক্ষুর একেবারে ভোঁতা‌, তা দিয়ে দাড়ি কামানো দূরের কথা‌, পেন্সিল কাটাও যায় না। তখন আর সন্দেহ রইল না। যে‌, এই ক্ষুর দিয়েই দু’জন লোকের গলা কাটা হয়েছে এবং তার ফলেই ক্ষুদ্রটি ভোঁতা হয়ে গেছে। ডাক্তারি পরীক্ষাতেও প্রমাণ হলো যে‌, ওই ক্ষুর দিয়েই দু’জনের গলা কাটা হয়েছিল।

0 Shares