বেণীসংহার

‘কিন্তু ক্ষুর ছিল ঘরের মধ্যে‌, আসামী এসেছিল বাইরে থেকে; ঘরে ঢোকবার আগেই সে ক্ষুর পেল কোথা থেকে? নিশ্চয় কেউ ক্ষুরটি আগেই ঘর থেকে সরিয়েছিল।

‘কে সরাতে পারে? সেদিন সকালে মেঘরাজ ওই ক্ষুর দিয়ে বেণীমাধবের দাড়ি কামিয়ে দিয়েছিল; তারপর সারা দিনে তাঁর ঘরে যারা এসেছিল তারা কেউ ক্ষুরের কাছে যায়নি। ও ঘরে নিত্য আসে যায় কেবল দু’জন; মেঘরাজ ও মেদিনী। মেঘরাজ নিজের গলা কাটবার জন্যে ক্ষুর চুরি করবে না। তাহলে বাকি রইল কে?’

সকলের দৃষ্টি মেদিনীর ওপর গিয়ে পড়ল। মেদিনী দেয়ালে ঠেস দিয়ে আগের মতাই বসে আছে‌, মাথার ওপরকার আচলটা দু’ হাতে একটু তুলে ধরে নির্নিমেষ চোখে ব্যোমকেশের পানে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ সনৎ কথা বলল–’একটা কথা বুঝতে পারছি না। হত্যাকারী মামার ক্ষুর দিয়ে গলা কাটতে গেল কেন? অন্য অস্ত্র কি ছিল না?’

ব্যোমকেশ বলল—’আসামী লোকটা ভারি ধূর্ত। সে জানে যে-অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয় সে-অস্ত্রকে বেবাক লোপাট করে দেওয়া সহজ নয়। তাই সে মতলব করেছিল‌, বেণীমাধবের ক্ষুর দিয়ে গলা কাটবার পর ক্ষুরটি ভাল করে মুছে যথাস্থানে রেখে দেবে‌, ওই ক্ষুর দিয়ে যে খুন হয়েছে একথা কারুর মনেই আসবে না‌, পুলিস অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াবে। বুঝতে পেরেছেন?’

‘পেরেছি। এবার আপনার বক্তৃতা শেষ করুন।’

ব্যোমকেশ আবার নির্লিপ্ত স্বরে বলতে আরম্ভ করল—‘মেদিনী ছোট ঘরের মেয়ে, কিন্তু পুরুষের চোখ দিয়ে যারা ওর পানে তাকিয়েছে তারাই জানে কী প্রচণ্ড ওর দেহের চৌম্বক শক্তি। সে সুচরিত্রা মেয়ে কিনা তা আমরা জানি না। যদি কুচরিত্রা হয় তাহলে মনে রাখতে হবে যে‌, মেঘরাজ ও বৃদ্ধ বেণীমাধব ছাড়া বাড়িতে আরো পাঁচজন সমর্থ পুরুষ আছে। স্ত্রী-পুরুষের অবৈধ আসক্তির ফলে অসংখ্য ট্র্যাজেডি ঘটেছে‌, আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

থেকে তার দিল্লীর ঠিকানা সংগ্রহ করলাম। তারপর একটা অপ্রত্যাশিত জিনিস পেলাম। মেদিনীর একটি চুল-বাঁধার কাঠের বাক্স ছিল‌, তার ডালা খুলে দেখলাম আয়নার ওপর একটা ফটো আটা রয়েছে। মেদিনীর ফটো্‌্‌, সাম্প্রতিক ছবি। সে খাটের ধারে বসে হাসছে। আমি আবার বাক্সের ডালা বন্ধ করে দিলাম‌, মেদিনী কিছু জানতে পারল না। পরদিন শুনলাম বাক্সটা চুরি গিয়েছে। ‘ ব্যোমকেশ ঘাড় তুলে রাখালবাবুর পানে চাইল।

রাখালবাবু টেবিলের ওপরে সুটকেসটা খুলতে খুলতে অবিচলিত মুখে বললেন-চুরি গিয়েছিল‌, আমরা খুঁজে বার করেছি।’ তিনি সুটকেস থেকে প্রসাধনের বাক্সটা বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন।

ব্যোমকেশ বলল–’ছবিটা আছে নিশ্চয়।’

রাখালবাবু ডালা খুলে বললেন—’আছে। ‘ কে চুরি করেছিল‌, কোথায় পাওয়া গেল এ সম্বন্ধে তিনি নীরব রইলেন। মনে হয়-চুরির ব্যাপারটা নিছক ধোঁকার টাঁটি।

ব্যোমকেশ বলল–’বেশ। তারপর আমরা বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে একে একে দেখা করলাম। বাড়িতে যতগুলো বিষতি ছিল সংগ্রহ করলাম; কেবল মকরন্দর বিষতি পাওয়া গেল না। মকরন্দ সম্বন্ধে একটা কথা মনে রাখা দরকার।–বেণীমাধবের হুকুমে মেঘরাজ তার গালে চড় মেরেছিল; অর্থাৎ দু’জনেরই ওপর তার গভীর আক্রোশ। সে-রাত্রে ন’টার সময় সে বাড়িতে এসেছিল‌, তারপর গভীর রাত্রে কখন চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কেউ জানে না। সে যখন রেস-কোর্সে ধরা পড়ল তখন তার পকেটে পৌঁনে দুশো টাকা ছিল। কোথা থেকে সে এত টাকা পেল তা বলতে চায় না।

‘যাহোক‌, বিষতি কোন সংগ্রহ করলাম সেই কথা বলি। যারা মতলব এঁটে ঘুমন্ত লোকের গলা কাটতে যায়। তারা জানে এই উপায়ে নিঃশব্দে খুন করা যায় বটে‌, কিন্তু আততায়ীর নিজের কাপড়-চোপড়ে প্রচুর রক্ত লাগার সম্ভাবনা। কাপড়-চোপড়ে রক্ত লাগলে সহজে ধোয়া যায় না‌, রক্তের দাগ থেকে যায়। তাই পাশ্চাত্ত্য দেশে খুন করবার সময় খুনী গায়ে বিষতি চড়িয়ে নেয়; বিষতির তেলা গায়ে যেটুকু রক্ত লাগে তা সহজেই ধুয়ে ফেলা যায়। পাশ্চাত্ত্য রহস্য রোমাঞ্চের বই যাঁরা পড়েছেন তাঁরাই একথা জানেন। আমরা বিষতিগুলোকে মালিকের নামের টিকিট মেরে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্যে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দিলাম।

‘তারপর আমি গেলাম দিল্লী। এতক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আসামী কে‌, কিন্তু আরো পাকা প্রমাণের দরকার ছিল। দিল্লীতে গিয়ে যে-বস্তিতে মেঘরাজ থাকত‌, সেখানে খোঁজখবর নিতেই অনেক কথা বেরিয়ে পড়ল। মেদিনী মেঘরাজের স্ত্রী নয়। মেঘরাজ বিপত্নীক ছিল; বেণীমাধব যখন তাকে বললেন‌, স্ত্রীকে নিয়ে এসো‌, তখন সে দিল্পী গিয়ে মেদিনীকে স্ত্রী সাজিয়ে নিয়ে এল। মেদিনীর স্বামী আছে‌, কিন্তু তার চরিত্র ভাল নয়; মেঘরাজের সঙ্গে আগে থাকতেই তার ঘনিষ্ঠতা ছিল; সে মেঘরাজের সঙ্গে পালিয়ে এল। বুঝে দেখুন মেদিনী কি রকম মেয়েমানুষ।’

মেদিনীর চোখ আতঙ্কে ভরে উঠেছিল‌, সে হঠাৎ চীৎকার করে উঠল—’না না‌, ঝুট বাত।’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পানে চোখ তুলল‌, তিনি দোরের দিকে চেয়ে হাঁক দিলেন—’হিন্মৎলাল!’

যে পশ্চিমা যুবককে ব্যোমকেশ দিল্লী থেকে সঙ্গে এনেছিল সে ঘরে প্রবেশ করল; চুড়িদার পায়জামা ও শেরোয়ানি পরা ক্ষীণকায় যুবক। ব্যোমকেশ তার দিকে আঙুল দেখিয়ে মেদিনীকে জিজ্ঞেস করল–’একে চিনতে পার?’

মেদিনী তড়িৎপৃষ্টের মত উঠে দাঁড়িয়েছিল‌, ভয়ার্তা চোখে হিম্মৎলালের দিকে একবার চেয়ে আবার মাটিতে আছড়ে পড়ল‌, মাটিতে মুখ গুজে পড়ে রইল।

‘হিস্মৎলাল‌, মেদিনী তোমার কে?’

0 Shares