বেণীসংহার

‘জি‌, মেদিনী আমার বিয়াহী ঔরৎ‌, আমাকে ছেড়ে মেঘরাজের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল।’

‘আচ্ছা‌, তুমি এখন বাইরে যাও।’

হিম্মৎলাল মেদিনীর পানে বিষদৃষ্টি হেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করল—’দেখা যাচ্ছে মেদিনীই যত নষ্টের গোড়া। সে স্বামীকে ছেড়ে মেঘরাজের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল‌, তারপর এখানে এসে আর একজন উচ্চতর বর্গের মানুষকে তার মোহময় কুহকজালে জড়িয়ে ফেলল। কিন্তু মেঘরাজ কড়া প্রকৃতির লোক‌, সে জানতে পারলে মেদিনীর উচ্চাশা ধূলিসাৎ হবে; তাই তাকে সরানো দরকার হয়ে পড়ল। কিন্তু একলা মেঘরাজকে খুন করলে ধরা পড়ার ভয় আছে‌, তাই মেঘরাজের সঙ্গে বেণীমাধবকেও খুন করে পুলিসের চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। বেণীমাধবের সঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়েদের বিরোধ যে বেশ ঘনিয়ে উঠেছে তা মেদিনীর অজানা ছিল না।

‘কিন্তু সত্যিই কি মেদিনী নিজের হাতে দু’জনের গলা কেটেছে? ছোরা ছুরি ক্ষুর মেয়েদের অস্ত্র নয়‌, মেয়েদের অস্ত্র বিষ; বিষ খাওয়াবার সুযোগ থাকলে তারা ছোরা ছুরি ব্যবহার করে না। মেদিনীর বিষ খাওয়াবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল‌, সে বেণীমাধব ও মেঘরাজের খাবার নিজের হাতে রান্না করত।

‘দেখা যাক‌, মেদিনীর সহকারী কে?–মেদিনী‌, তোমার চুল বাঁধার বাক্সে আয়নার গায়ে একটা ফটো লাগানো আছে। কে ফটো তুলেছিল?’

মেদিনী উত্তর দিল না‌, মাটিতে মুখ গুজে পড়ে রইল। ব্যোমকেশ তখন সনতের দিকে ফিরে বলল–’সনৎবাবু্‌, আপনি ফটোগ্রাফির বিশেষজ্ঞ‌, দেখুন তো একবার ছবিটা।’

সনৎ ব্যোমকেশের পানে সন্দেহভরা ভ্রূকুটি করল‌, তারপর অনিচ্ছাভরে উঠে এল। রাখালবাবু বাক্সের ডগলা খুলে ধরলেন। সনৎ সামনে ঝুকে ছবিটা দেখল; তার মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। সে অবরুদ্ধ স্বরে বলল—’মেদিনীর ছবি।’

ব্যোমকেশ বলল–’কে ছবি তুলেছে বলতে পারেন?’

‘তা কি করে বলব!’

‘ভাল করে দেখুন। মেদিনীকে খাটে বসিয়ে ছবি তোলা হয়েছে‌, মেদিনীর পেছনে খাটের মাথায় কারুকার্য দেখা যাচ্ছে। কার খাট চিনতে পারছেন না?’

সনতের চোখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল–’কি বলতে চান আপনি?’

ব্যোমকেশ বলল–’আপনি নিজের ঘরে রাত্তির বেলা ফ্ল্যাশ-লাইট দিয়ে মেদিনীর ছবি তুলেছিলেন। আপনি মেদিনীর গুপ্ত-প্রণয়ী। মেঘরাজ যখন বেণীমাধবের দোরের সামনে শুয়ে ঘুমোত তখন মেদিনী আপনার ঘরে যেত।’

সনৎ কিছুক্ষণ জবাফুলের মত লাল চোখে চেয়ে রইল‌, শেষে বিকৃত গলায় বলল—’তাতে কি প্রমাণ হয় আমি মামকে খুন করেছি?’

‘সনৎবাবু্‌, আপনি মেদিনীর মোহে পড়ে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়েছিলেন‌, মেঘরাজকে খুন করে মেদিনীর ওপর একাধিপত্য স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আপনার বোধহয় প্ল্যান ছিল খুনের মামলা মিটে গেলে মেদিনীকে নিয়ে অন্য কোথাও বাসা বাঁধবেন।’

‘আমি খুন করিনি।’

‘আপনার দেহে খুনীর রক্ত আছে‌, আপনার বাবা আপনার মাকে খুন করে ফাঁসি গিয়েছিলেন।’

‘আমি খুন করিনি। খুন করেছে-ওই মেদিনী।’

মেদিনী ধড়মড়িয়ে হাঁটুর ওপর উঠে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে উঠল-‘নেহি নেহি নেহি–’

ব্যোমকেশ বলল—’ঠিক কথা। মেদিনী নিজের হাতে খুন করেনি। খুন করেছেন। আপনি।’

‘প্রমাণ আছে?’

‘ছোট্ট একটা প্রমাণ আছে। খুন করার পর আপনি বষতিটাকে খুব ভাল করেই ধুয়েছিলেন‌, কিন্তু পকেটের মধ্যে কয়েক ফোঁটা রক্ত রয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষা করে দেখা গেছে‌, রক্তটা বেণীমাধববাবুর ব্লাড-গ্রুপের রক্ত।’

মেদিনী বলে উঠল—’হ্যাঁ হ্যাঁ, সনৎবাবু খুন করেছে‌, আমি কিছু জানি না‌, আমি বে-কসুর।’

হঠাৎ সনৎ বুনো মোষের মত ঘাড় নীচু করে চাপা গর্জন করতে করতে মেদিনীর দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর ইতিমধ্যে সনতের দু’পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন‌, তাঁরা সনতকে ধরে ফেললেন। রাখালবাবু তার হাতে হাতকড়া পর্যালেন। সনতের ক্ষিপ্র উন্মত্ততা হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। দুই প্রহরীর মাঝখানে সে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মেদিনী আবার বলে উঠল—’আমি কিছু জানি না‌, আমি বে-কসুর।’

ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে বলল—’না মেদিনী‌, তুমি বে-কসুর নও। বেণীমাধববাবুর ক্ষুর চুরি করে তুমিই সনৎবাবুকে দিয়েছিলে। তারপর সে যখন গভীর রাত্রে ফিরে এসে সদর দোরে টোকা দিয়েছিল তখন তুমি দোর খুলে তাকে ভিতরে এনেছিলে; সে কাজ সেরে চলে যাবার পর তুমি দোর বন্ধ করে দিয়েছিলে। তোমরা দু’জন সমান অপরাধী।’

মেদিনী আবার মেঝের ওপর আছড়ে পড়ল।

ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে। আসামী দু’জনকে চালান করে দিয়ে রাখালবাবু বাড়ির ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিয়েছেন। বাইরে ঘনায়মান সন্ধ্যা। রাখালবাবুসনতের ঘরে গিয়ে তার আলমারি খুলে অ্যালবামের সারি থেকে একটি একটি অ্যালবাম খুলে পাতা উল্টে দেখছিলেন। ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে সিগারেট টানতে টানতে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

রাখালবাবু অবশেষে একটি অ্যালবাম হাতে নিয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে বসলেন‌, নিবিষ্ট মনে অ্যালবামের ছবিগুলি দেখতে লাগলেন। প্রতি পৃষ্ঠায় একটি শিথিলবসনা তরুণীর ছবি। শিকারী যেমন বাঘ শিকার করে তার চামড়া দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে‌, সনৎ যেন প্রকারান্তরে তাই করেছে।

অ্যালবাম শেষ করে রাখালবাবু একটি নিশ্বাস ফেললেন‌, সিগারেট ধরিয়ে বললেন–সনৎ গাঙ্গুলির রক্তে পাগলামির বীজ আছে‌, কিন্তু সে যে একটি রসিক চূড়ামণি তাতে সন্দেহ নেই।’

ব্যোমকেশ কাছে এসে অ্যালবামের পাতা উলটে দেখল‌, তারপর বলল—’শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য বলেছেন‌, নারী নরকের দ্বার। সনৎ নরকের অনেকগুলো দ্বার খুলেছিল‌, তাই শেষ পর্যন্ত তার নরক-প্রবেশ অনিবাৰ্য হয়ে পড়ল।’

0 Shares