কিন্তু বেশি দিন তালাবন্ধ রইল না। বেণীমাধবের দুই মামাতো ছোট বোন ছিল, বহুদিন মারা গেছে; তাদের দুই ছেলে সনৎ গাঙ্গুলি ও নিখিল হালদার-পরম্পর মাসতুতো ভাই-কলকাতায় চাকরি করত; তাদের ভাল বাসা ছিল না, তাই বেণীমাধব তাদের নিজের বাড়িতে এনে রাখলেন। নীচের দু’টি ঘর নিয়ে তারা রইল।
দেখা যাচ্ছে, বেণীমাধবের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী এবং দুই ভাগনে মিলে সাতজন পোষ্য। বাড়িতে চাকর নেই, দুটো দাসী দিনের বেলা কাজ করে দিয়ে সন্ধ্যের সময় চলে যায়।
নিতান্তাই বৈচিত্র্যহীন পারিবেশ। শালা-ভগিনীপতির বয়স প্রায় সমান, তেতাল্লিশ চুয়াল্লিশ; কিন্তু তাদের মধ্যে মানসিক ঘনিষ্ঠতা নেই, দু’জনের আকৃতি প্রকৃতি দুরকম। অজয় সুশ্ৰী ও শৌখিন গোছের মানুষ, গিলে-করা ধুতি-পাঞ্জাবি ও পালিশ-করা পাম্প-শু ছাড়া সে বাড়ির বার হয় না। রোজ সকালে গড়িয়াহাটে বাজার করতে যাওয়াতে তার ঘোর আপত্তি্্, অধিকাংশ দিন তার স্ত্রী আরতিই বাজারে যায়। অজয় সন্ধ্যের পর ক্লাবে যায়; শখের থিয়েটারের প্রতি তার গাঢ় অনুরাগ। অভিনয় ভালই লাগে। ক্লাবটা শখের থিয়েটারেরই ক্লাব, প্রতি বছর তারা চার-পাঁচখানা নাটক অভিনয় করে।
গঙ্গাধরের চেহারাটা কাপালিক ধরনের; মুখে এবং দেহে মাংস কম, হাড় বেশি। চোখের দৃষ্টি খর। নিজের বিষয়সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়ে শ্বশুরের স্কন্ধে আরোহণ করার পর সে অত্যন্ত গম্ভীর এবং মিতভাষী হয়ে উঠেছে। সারা দিন বাড়ি থেকে বেরোয় না, সন্ধ্যের পর লাঠি হাতে নিয়ে বেড়াতে বেরোয়। ঘন্টা দেড়েক পরে যখন ফিরে আসে তখন তার মুখ থেকে ভ্রূর ভুর করে মদের গন্ধ বের হয়।
ননন্দ-ভাজের মধ্যে প্রকাশ্যত সদ্ভাব ছিল, যাওয়া-আসা গল্পগুজবও চলত; কিন্তু সুবিধে পেলে কেউ কাউকে চিমটি কাটতে ছাড়িত না। গায়ত্রী হয়তো পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে বলল–’বৌদি, আজাকি রান্নাবান্না করলে?’
আরতি রান্নার ফর্দ দিয়ে বলত—’তুমি কি রাঁধলে ভাই?’
গায়ত্রী বলল–’রান্না আর হলো কই। ভাতের ফ্যান গেলে মাংস চড়াতে গিয়ে দেখি গরম মশলা নেই! জানো তো তোমার নন্দাই শাক-ভাত খেতে পারেন না! ওঁর মাছ না হলেও চলে কিন্তু রোজ মাংস চাই। তাই খোঁজ নিতে এলুম তোমার ভাঁড়ারে গরম মশলা আছে কিনা। নইলে আবার বিকে বাজারে পাঠাতে হবে।’
আরতি বলল–’আছে বৈকি, এই যে দিচ্ছি।’
গরম মশলা এনে দিয়ে আরতি হাসি-হাসি মুখে বলল–’নন্দাই মাংস ভালবাসেন তাতে দোষ নেই, কিন্তু ভাই, ও জিনিসটা না খেলেই পারেন।’
গায়ত্রীর দৃষ্টি অমনি কড়া হয়ে উঠল—’কোন জিনিস?’
আরতি ভালমানুষের মত মুখ করে বলল–’তোমার দাদা বলছিলেন সেদিন সন্ধ্যের পর নন্দাই-এর মুখোমুখি দেখা হয়েছিল, তা নন্দাই-এর মুখ থেকে ভক করে মদের গন্ধ বেরুল। নন্দাই-এর বোধহয় পুরনো অভ্যোস, ছাড়তে পারেন না, কিন্তু কথাটা যদি বাবার কানে ওঠে—‘
গায়ত্রীর কঠিন দৃষ্টি কুটিল হয়ে উঠল, সে মুখে একটা বাঁকা হাসি টেনে এনে বলল–’বাবার কানে যদি কথা ওঠে তাহলে তোমরাই তুলবে বৌদি। কিন্তু সেটা কি ভাল হবে? তোমার মেয়ের জন্য নাচের মাস্টার রেখেছ তাতে দোষ নেই কিন্তু লাবনি রাত দুপুর পর্যন্ত মাস্টারের সঙ্গে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরে সেটা কি ভাল? লাব্রণি কচি খুকি নয়, যদি একটা কেলেঙ্কারি করে বসে তাতে কি বাবা খুশি হবেন? গায়ত্রী আচল ঘুরিয়ে চলে গেল।
সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।
লাবণি মেয়েটি দেখতে ভাল; ছিপছিপে লম্বা গড়ন, নাচের উপযোগী চেহারা। একটু চপল প্রকৃতি, লেখাপড়া স্কুলের সীমানা পার হবার আগেই শেষ হয়েছে; নৃত্যকলার প্রতি তার দুরন্ত অক্টেরাগ। অজয় মেয়ের মনের প্রবণতা দেখে তার জন্যে নাচের মাস্টার রেখেছিল। মাস্টারটি বয়সে তরুণ, সম্পন্ন ঘরের ছেলে, নাম পরাগ লাহা; হাপ্তায় দুদিন লাবণিকে নাচ শেখাতে আসত। বাপ-মায়ের চোখের সামনে লাব্রণি নাচের মহলা দিত। কদাচিৎ পরাগ বলত—’একটা নাচ-গানের বিলিতি ছবি এসেছে, দুটো টিকিট কিনেছি। রাত্রির শোতে। লাবণিকে নিয়ে যাব? ছবিটা দেখলে ও অনেক শিখতে পারবে।’
গোড়ার দিকে আরতি রাজী হতো না। পরাগ বলত–’থাক, আমি অন্য কোনো ছাত্রীকে নিয়ে যাব।’
ক্রমে আপত্তি শিথিল হয়ে আসে, লাব্রণি পর্যাগের সঙ্গে ছবি দেখতে যায়; দুপুর রাত্রে পরাগ লাবণিকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
কালধৰ্মে সবই গা-সওয়া হয়ে যায়।
লাবণির দাদা মকরন্দ কলেজে পড়ে। কিন্তু পড়া নামমাত্র; কলেজে নাম লেখানো আছে। এই পর্যন্ত। তার মনের দিগন্ত জুড়ে আছে রাজনৈতিক দলাদলি, দলগত প্রয়োজনে যদি কলেজে যাওয়া প্রয়োজন হয় তবেই কলেজে যায়। তার চেহারা ভাল, কিন্তু মুখে চোখে একটা উগ্র ক্ষুধিত অসন্তোষ। সে বাড়িতে বেশি থাকে না; বাড়ির সঙ্গে কেবল খাওয়া আর শোয়ার সম্পর্ক। মাঝে মাঝে আরতির সংসার-খরচের টাকা অদৃশ্য হয়; আরতি বুঝতে পারে কে টাকা নিয়েছে, কিন্তু অশান্তির ভয়ে চুপ করে থাকে। মকরুন্দ তার থিয়েটার-বিলাসী বাপকে বিদ্বেষ করে, অজয়ও ছেলের চালচলন পছন্দ করে না; দু’জনে পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। মকরন্দ যেন তার বাপ-মায়ের সংসারে অবাঞ্ছিত অতিথি।
পাশের ফ্ল্যাটে সংসার ছোট; কেবল একটি মেয়ে ঝিল্লী। ঝিল্লী লাবণির সমবয়সী, লাবণর মত সুন্দরী নয়, কিন্তু পড়াশোনায় ভাল। চাপা প্রকৃতির মেয়ে, কলেজে ভর্তি হয়েছে, নিয়মিত কলেজে যায়, লেখাপড়া করে, অবসর পেলে মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করে। তার শান্ত মুখ দেখে মনের খবর পাওয়া যায় না।