‘কিন্তু সনৎ মেদিনীর মত মেয়ের জন্য এমন ভয়ঙ্কর কাজ করল ভাবতে আশ্চর্য লাগে।’
‘রাখাল, মেদিনীর মত মেয়েকে তুচ্ছ জ্ঞান কোরো না। যুগে যুগে এই জাতের মেয়েরা জন্মগ্রহণ করেছে-কখনো ধনীর ঘরে কখনো দরিদ্রের ঘরে-পুরুষের সর্বনাশ করার জন্যে। দ্ৰৌপদী। এই জাতের মহিলা ছিলেন-কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মূলে আছে দ্রৌপদী। ইলিয়ডের হেলেনও তাই। এ যুগেও এই জাতের মেয়ের অভাব নেই। ওরা সকলেই যে চরিত্রহীনা তা নয়, কিন্তু ওদের এমন একটা কিছু আছে যা পুরুষকে-বিশেষত সন্নতের মত দুশ্চরিত্র পুরুষকে-ক্ষেপিয়ে দিতে পারে, কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্মত্ত করে তুলতে পারে। জ্যেষ্ঠ আলেকজান্ডার দুমা একটা বড় দামী কথা বলেছিলেন–cherchez la femme: যেখানে এই ধরনের ব্যাপার ঘটে সেখানে মেয়েমানুষ খুঁজবে, মূলে মেয়েমানুষ আছে।’
‘তা বটে।’ রাখালবাবু। উঠলেন-দেখা যাচ্ছে বেণীমাধবের মেয়ে এবং পুত্রবধূ তাঁকে বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করেনি, বৃদ্ধের জীর্ণ পাকযন্ত্রই দায়ী।–চলুন, এবার যাওয়া যাক। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, এক পেয়ালা গরম চায়ের জন্যে প্ৰাণ কাঁদছে।’
‘চল আমার বাড়িতে, তরিবৎ করে চা খাওয়া যাবে।’
‘উত্তম প্রস্তাব।’
ঘরের বাইরে এসে রাখালবাবু দোরে তালা লাগালেন, তারপর সদর দরজার দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন। ঝিল্লী সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে, তার পিছনে প্রকাণ্ড ট্রের ওপর চায়ের সরঞ্জাম এবং কচুরি-নিমকির প্লেট নিয়ে দাসী আসছে। ব্যোমকেশ বলল—’রাখাল, তোমার প্রাণের কান্না ভগবান শুনতে পেয়েছেন। চল, ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসা যাক।’
রাখালবাবু সাবধানী লোক, বললেন–‘দাঁড়ান, না আঁচলে বিশ্বাস নেই।’
কী তাদের কাছে এসে সলজ স্বরে বলল—’মা আপনাদেরর জন্যে চা জলখাবার পাঠিয়ে দিলেন।‘
‘দেখলে তো?’ সকলে ড্রয়িং রুমে গেল। ঝি টেবিলের ওপর ট্রে রেখে চলে গেল; ঝিল্লীও তার অনুগমন করছিল, ব্যোমকেশ বলল—’ঝিল্লী, আমরা বড় ক্লান্ত; তুমি আমাদের চা ঢেলে দাও, আমরা বসে বসে খাই।’
ঝিল্লী ফিরে এসে টি-পট থেকে তাদের চা ঢেলে দিল, জলখাবারের প্লেট তাদের সামনে রাখল। ব্যোমকেশ অর্ধমুদিত চোখে কচুরি চিবোতে চিবোতে দেখল, ঝিল্লী গুটি গুটি দোরের দিকে যাচ্ছে।
‘ঝিল্লী, শোনো, চলে যেও না। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
ঝিল্পী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর আস্তে আস্তে ফিরে এসে ব্যোমকেশের পাশে দাঁড়াল। ব্যোমকেশ সংকেত।ভরা চোখে রাখালবাবুর পানে তাকাল; রাখালবাবু অলসভাবে চায়ের পেয়ালা শেষ করে একটি গানের কলি গুঞ্জন করতে করতে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
ঝিল্লী ব্যোমকেশের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তার যে বুক চিবচিব করছে তা তার মুখ দেখে বোঝা যায় না। ব্যোমকেশ খাটো গলায় একটু হাসল, বলল–’সম্পর্কে নিখিল তোমার মামা হয় বটে, কিন্তু অনেক দূরের সম্পর্ক। আইনত বিয়ে আটকায় না।’
ঘরের ছায়া-ছায়া অন্ধকারে দেখা গেল না-ঝিল্লীর মুখ রাঙা হয়ে উঠেছে। তারপর তার ক্ষীণস্বর শোনা গেল–’কি করে জানলেন?’
ব্যোমকেশ বলল—’বোকা মেয়ে! সবগুলো চিঠিতেই তোমার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।–আচ্ছা, তুমি এখন কোণের চেয়ারে গিয়ে বোসো। আরো কথা আছে।’
ঝিল্লী নেংটি ইদুরের মত ঘরের অন্ধকার কোণে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘরে যেন ব্যোমকেশ ছাড়া আর কেউ নেই।
বাইরে দুজোড়া জুতোর শব্দ শোনা গেল। রাখালবাবু নিখিলকে নিয়ে ফিরে এলেন।
‘রাখাল, আলোটা জ্বেলে দাও।’
দোরের পাশে সুইচ। রাখালবাবু সুইচ টিপলেন, কয়েকটা উজ্জ্বল বালব জ্বলে উঠল। নিখিল কোনোদিকে না তাকিয়ে ব্যোমকেশের পাশে গিয়ে বসল, অনুরাগপূর্ণ চোখে তার পানে চেয়ে বলল—’ব্যোমকেশদা, আপনি ভেলকি জানেন। সনৎদা আমার মাসতুত ভাই, তাকে সারা জীবন দেখছি, কিন্তু সে যে এমন মানুষ তা ভাবতেও পারিনি।’
ব্যোমকেশ বলল–’নিখিল, মুখ দেখে যদি মানুষের মনের কথা জানা যেত, তাহলে আইন, আদালত, পুলিস, সত্যান্বেষী কিছুই দরকার হতো না; তুমিও মুখ দেখেই বুঝতে পারতে কোন মেয়েটি তোমাকে বেনামী চিঠি লেখে।’
‘তা তো বটেই, তা তো বটেই।’ নিখিল ব্যোমকেশের আর একটু কাছে ঘেঁষে বসিল, ষড়যন্ত্রকারীর মত ফিসফিস করে বলল–’আপনি কিছু বুঝতে পেরেছেন নাকি?’
ব্যোমকেশ হাসল–’আগে তুমি বলে দেখি মেয়েটির সন্ধান যদি পাওয়া যায় তুমি কি করবে?’
নিখিলের চোখ উদ্দীপনায় জ্বলজ্বল করে উঠল–’কী করব? বিয়ে করব। কানা হোক, খোঁড়া হোক, কাফ্রি হোক, হাবসি হোক, তাকে বিয়ে করব।’
ব্যোমকেশ বলল–’তাহলে সন্ধান পাওয়া গেছে।–ঝিল্লী, এদিকে এসো।’
নিখিল চকিত হয়ে দোরের দিকে চাইল। ওদিকে ঘরের কোণে ঝিল্লীর সাড়াশব্দ নেই, সে চেয়ারের পিছনে লুকিয়েছে। নিখিল ব্যোমকেশের দিকে ফিরে উত্তেজিত স্বরে বলল—‘কাকে ডাকলেন?’
‘এই যে দেখাচ্ছি–ব্যোমকেশ উঠে গিয়ে ঝিল্লীর হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল, তাকে হাত ধরে নিখিলের কাছে এনে বলল–’এই নাও তোমার বিবি পোকা। বিবি পোকাকে চোখে দেখা যায় না, কেবল ঝংকার শোনা যায়। আমরা কিন্তু ধরেছি।’
নিখিলের মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম করল। সে দু’ হাত তুলে চীৎকার করল–’অ্যাঁ! ঝিল্লী-ঝিল্লী আমাকে চিঠি লেখে! ঝিল্লী আমাকে ভালবাসে! কিন্তু–কিন্তু ও যে আমার ভাগনী!’
ব্যোমকেশ হেসে বলল–’ভয় নেই, ভয় নেই। ঝিল্লী ভরি সেয়ানা মেয়ে, অপাত্রে হৃদয় সমৰ্পণ করেনি। তোমাদের যা সম্পর্কে তাতে বিয়ে আটকায় না।’