ঝিল্লীর মুখ অবনত, ঠোঁটের কোণে ভীরু হাসির যাতায়াত। নিখিলের মুখে ক্রমে ক্রমে একটি প্রকাণ্ড হাসি ফুটে উঠল, সে বলল—’উঃ, কী সাংঘাতিক আজকালকার মেয়ে দেখেছেন ব্যোমকেশদা, আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছিল। আচ্ছা, আমিও দেখে নেব। বিয়েটা হয়ে যাক—’
এই সময় দোরের সামনে গঙ্গাধরকে দেখা গেল। লাঠি হাতে সে বোধহয় সায়াট্রিক নিত্যকর্ম করতে বেরুচ্ছিল। ঘরের মধ্যে গলার আওয়াজ শুনে ঘরে ঢুকেছে। এই অল্পক্ষণের মধ্যেই তার মেজাজ আবার সপ্তমে চড়ে গিয়েছে, সে রাখালবাবুকে লক্ষ্য করে কড়া সুরে বলল–’এখানে আপনার কাজ শেষ হয়েছে, এখনো এখানে রয়েছেন কেন?’ রাখালবাবু উত্তর দেবার আগেই তার চোখ পড়ল ঝিল্লীর ওপর, অমনি ভয়ঙ্কর ভ্রূকুটি করে সে বলল-ঝিল্লী! তুই এখানে পুরুষদের মধ্যে কি করছিস?’
বোপকে দেখে ঝিল্লী একেবারে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, এখন চমকে উঠে ব্যোমকেশের পিছনে লুকোবার চেষ্টা করল। গঙ্গাধর বলল–’ধিঙ্গি মেয়ে! পুরুষ-ঘেঁষা স্বভাব হয়েছে। চাবকে লাল করে দেব।’
নিখিল হঠাৎ যেন ক্ষেপে গেল, এক লাফে গঙ্গাধরের সামনে গিয়ে বলল—’মুখ সামলে কথা বলুন। ঝিল্পীকে আমি বিয়ে করব।’
গঙ্গাধর প্রথমটা থতমত খেয়ে গেল, তারপর তারস্বরে চিকুর ছাড়ল—‘কী, আমার মেয়েকে বিয়ে করবি তুই, হতভাগা ছাপাখানার ভূত! ঠেঙিয়ে তোর হাড় ভেঙে দেব না।’ সে লাঠি আস্ফালন করতে লাগল।
এই গায়ত্রী ঘরে ঢুকল, উন্ন দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে বলল–’কি হয়েছে, এত চেঁচামেচি কিসের?’
গঙ্গাধর কৰ্ণপাত করল না, চেচিয়ে বলল–’বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। ছোট মুখে বড় কথা। আমার মেয়েকে তুই বিয়ে করবি।’
ঝিল্লী ছুটে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলা, কানে কানে বলল–’মা, তুমি যদি অমত কর আমি বিষ খেয়ে মরব।’ চরম অবস্থার সম্মুখীন হয়ে ঝিল্লীর মুখে কথা ফুটেছে।
গায়ত্রী একবার নিখিলকে ভাল করে দেখল, যেন আগে কখনো দেখেনি। নিখিল গিয়ে তার পায়ের ধুলো নিল। বলল–’দিদি, ঝিল্লীকে আমি-মানে আমাকে ঝিল্লী বিয়ে করতে চায়। ব্যোমকেশদা বলেছেন সম্পর্কে বাধে না।’
গায়ত্রী ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করল—’সত্যি সম্পর্কে বাধে না?’
ব্যোমকেশ বলল—’না, ওরা first cousin নয়, সম্পর্কে বাধে না।’
গঙ্গাধর আরো গলা চড়িয়ে চীৎকার করল—’শুনতে চাই না, কোনো কথা শুনতে চাই না। বেরিয়ে যাও তোমরা আমার বাড়ি থেকে, এই দণ্ডে বেরিয়ে যাও—’
গায়ত্রী ধমক দিয়ে উঠল—’থামো তুমি। বাড়ি তোমার নয়, বাড়ি আমার। আমি সুধাংশুবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি; বাবা উইল করার আগেই মারা গেছেন, আইনত তাঁর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক আমার, এ বাড়িরও অর্ধেক আমার।–তুমি বাইরে যেখানে যাচ্ছিলে যাও না। যা করার আমি করব।’
গঙ্গাধর পিন ফোটানো খেলনার বেলুনের মত চুপসে গেল, তারপর ঘাড় হেঁট করে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলো।
গায়ত্রী ঝিল্লীর বাহুবন্ধন থেকে গলা ছাড়িয়ে তার হাত ধরে সোফায় বসল, নিখিলের দিকে চেয়ে হাকিমের মত হুকুম করল–’কি কাণ্ড তোমরা বাধিয়েছ এবার বলো শুনি।’
নিখিল বলল–’আমি কিছু জানি না দিদি, ওই ওকে জিজ্ঞেস করো। ব্যোমকেশদা, চিঠিগুলো কোথায়?’
ব্যোমকেশ পকেট থেকে চিঠি বের করে দিয়ে বলল–’রাখাল, চল এবার আমাদের যাবার সময় হয়েছে। গায়ত্রী দেবী, চায়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। নিখিল, তুমি যে বৌ পেলে অনেক ভাগ্যে এমন বৌ পাওয়া যায়। ঝিল্লী, তুমিও কম সৌভাগ্যবতী নাও। জীবনে যে-জিনিস সবচেয়ে দুর্লভ, সেই দুর্লভ হাসি তুমি পেলে। তোমাদের জীবনে হাসির ঢেউ খেলতে থাকুক।–এসো রাখাল।’
(সমাপ্ত)