বেণীসংহার

এই গেল দোতলার মোটামুটি খবর।

নীচের তলার দু’টি ঘরে সনৎ আর নিখিল থাকে। সনতের বয়স ত্ৰিশের ওপর‌, নিখিলের ত্ৰিশের নীচে। চেহারার দিক থেকে দু’জনকেই সুপুরুষ বলা চলে। কিন্তু চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। সনৎ সংবৃতিচিত্ত ও মিতবাক‌, বিবেচনা না করে কথা বলে না। নিখিলের মুখে খৈ ফোটে‌, সে চটুল ও রঙ্গপ্রিয়। দু’জনেই সাংবাদিকের কাজ করে। সনৎ প্রেস-ফটোগ্রাফার। নিখিল খবরের কাগজের সংবাদ সম্পাদন বিভাগে নিম্নতর নিউজ এডিটর-এর কাজ করে। সে নিশাচর প্রাণী। —দেবতা ঘুমালে আমাদের দিন‌, দেবতা জাগিলে মোদের রাতি। ঋষ্যশৃঙ্গকে যারা প্রলুব্ধ করেছিল তাদেরই সমগোত্রীয়।

এরা কেউ বিয়ে করেনি। নিখিলের বিয়ে না করার কারণ‌, সে যা উপার্জন করে তাতে সংসার পাতা চলে না; কিন্তু সনতের সেরকম কোনো কারণ নেই। সে ভাল উপার্জন করে; মাতুলগৃহে তার বাস করার কারণ অর্থাভাব নয়‌, ভাল বাসার অভাব। তার বিবাহে অরুচির মূল অনুসন্ধান করতে হলে তার একটি গোপনীয় অ্যালবামের শরণ নিতে হয়। অ্যালবামে অনেকগুলি কুহকিনী যুবতীর সরস ফটো আছে। ফটোগুলি দেখে সন্দেহ করা যেতে পারে যে‌, সনৎ অবিবাহিত হলেও ব্রহ্মচারী নয়। কিন্তু সে অত্যন্ত সাবধানী লোক। সে যদি বিবাহের বদলে মধুকরবৃত্তি অবলম্বন করে থাকে‌, তাহলে তা সকলের অজান্তে।

এই সাতটি মানুষ বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। বেণীমাধব নামাসে ছ’মাসে আসেন‌, দুদিন থেকে আবার দিল্লী চলে যান। দিল্পীই তাঁর কর্মক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দু।

হঠাৎ সাতষট্টি বছর বয়সে বেণীমাধবের স্বাস্থ্যভঙ্গ হলো। তাঁর শরীর বেশ ভালই ছিল। অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর প্রিয় ভূত্য এবং দীর্ঘদিনের অনুচর রামভজনের মৃত্যুর পর তিনি আর বেশি দিন খাড়া থাকতে পারলেন না। তিন মাসের মধ্যে তিনি ব্যবসা গুটিয়ে ফেললেন। তাঁর টাকার দরকার ছিল না‌, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কাজের ঝোঁকেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। এখন দিল্লীর অফিস তুলে দিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে এলেন। সঙ্গে এল নতুন চাকর মেঘরাজ।

রামভজনের মৃত্যুর পর বেণীমাধব মেঘরাজকে খাস চাকর রেখেছিলেন। মেঘরাজ ভারতীয় সেনাদলের একজন সিপাহী ছিল; চীন-ভারত যুদ্ধে আহত হয়ে তার একটা পা হাঁটু পর্যন্ত কাটা যায়। ভারতীয় সেনাবিভাগের পক্ষ থেকে তাকে কৃত্রিম পা দেওয়া হয়েছিল এবং সামান্য পেনসন দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। সে বেণীমাধবের দিল্লীর অফিসে দরোয়ানের কাজ পেয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেছিল; রামভজনের মৃত্যুর পর বেণীমাধব তাকে খাস চাকরের কাজ দিলেন। মেঘরাজ অত্যন্ত বিশ্বাসী এবং কড়া প্রকৃতির মানুষ; সে বেণীমাধবের একক সংসারের সমস্ত কাজ নিজের হাতে তুলে নিল; তাঁর দাড়ি কামানো থেকে জুতো বুরুশ পর্যন্ত সব কাজ করে। তার বয়স আন্দাজ চল্লিশ; বলিষ্ঠ চেহারা। কৃত্রিম পায়ের জন্য একটু খুঁড়িয়ে চলে।

যাহোক‌, বেণীমাধব এসে কলকাতার বাড়িতে অধিষ্ঠিত হলেন। তেতলার অংশে নিত্য ব্যবহারের সব ব্যবস্থাই ছিল‌, কেবল ফ্রিজ আর টেলিফোন ছিল না। দুচার দিনের মধ্যে ফ্রিজ এবং টেলিফোনের সংযোগ স্থাপিত হলো। ইতিমধ্যে মেয়ে গায়ত্রী এসে আবদার ধরেছিল–’বাবা‌, এবার আমি তোমার খাবার ব্যবস্থা করব। আগে তুমি যখনই আসতে দাদার কাছে খেতে। আমরা কি কেউ নই?’

বেণীমাধব বলেছিলেন—’আমি তো একলা নাই‌, মেঘরাজ আছে।’

‘মেঘরাজ বুঝি নতুন চাকরের নাম? আহা‌, বুড়ো রামভজন মরে গেল। তা মেঘরাজকেও আমি খাওয়াব।’

বেণীমাধব বিবেচনা করে বললেন–’বেশ‌, কিন্তু তাতে তোমার খরচ বাড়বে। আমি তোমার মাসিক বরাদ্দ আরো দেড়শো টাকা বাড়িয়ে দিলাম।’

গায়ত্রী হেসে বলল–’সে তোমার যেমন ইচ্ছে।’ তার বোধহয় মনে মনে এই মতলবই ছিল; সে মাসে সাড়ে সাতশো টাকা পেত‌, এখন না শো টাকায় দাঁড়াল।

কলকাতায় এসেই বেণীমাধব তার পুরনো বন্ধু ডাক্তার অবিনাশ সেনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ডাক্তার অবিনাশ সেন নামকরা ডাক্তার‌, বয়সে বেণীমাধবের চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। তিনি একদিন বেণীমাধবকে নিজের ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেন; এক্স-রে‌, ই সি জি প্রভৃতি যান্ত্রিক পরীক্ষা হলো। তারপর ডাক্তার সেন বললেন—’দেখুন‌, আপনার শরীরে সিরিয়াস কোনো ব্যাধি নেই‌, যা হয়েছে তা হলো বার্ধক্যের স্বাভাবিক সবাঙ্গীন অবক্ষয়। আমি আপনাকে ওষুধ-বিষুধ কিছু দেব না‌, কেবল শরীরের গ্রন্থিগুলোকে তাজা রাখবার জন্যে মাসে একটা করে ইনজেকশন দেব। আসলে আপনি বয়সের তুলনায় বড় বেশি পরিশ্রম করেছিলেন। এখন থেকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম; বই পড়ুন‌, রেডিও শুনুন‌, রোজ বিকেলে একটু বেড়ান। এখনো অনেক দিন বাঁচবেন।’

বেণীমাধব ইনজেকশন নিয়ে সানন্দে বাড়ি ফিরে এলেন।

তারপর দিন কাটতে লাগল। গায়ত্রী নিজের হাতে থালা সাজিয়ে এনে ব্যাপকে খাইয়ে যায়। অন্য সকলে আসা-যাওয়া করে। মকরুন্দ বড় একটা আসে না‌, এলেও দু’ মিনিট থেকে চলে যায়। নাতনীরা থাকে‌, বেণীমাধবের সঙ্গে গল্প করে। ঝিল্লী পড়াশুনায় ভালো জেনে বৃদ্ধ সুখী হন; লাব্রণি নাচ শিখছে শুনেও তিনি অপ্রীত হন না। তিনি বয়সে প্রবীণ হলেও প্রাচীনপন্থী নন। সব মেয়েই যখন নাচছে তখন তাঁর নাতনী নাচবে না কেন?

দিন কুড়ি-পঁচিশ কাটবার পর হঠাৎ একদিন বেণীমাধবের শরীর খারাপ হলো; উদরাময়‌, পেটের যন্ত্রণা। ডাক্তার সেন এলেন‌, পরীক্ষা করে বললেন–খাওয়ার অত্যাচার হয়েছে‌, খাওয়া সম্বন্ধে ধরা-বাঁধার মধ্যে থাকতে হবে।’

0 Shares