বেণীসংহার

বাড়ির সকলেই উপস্থিত ছিল। গায়ন্ত্রী শুকনো মুখে বলল–’কিন্তু ডাক্তারবাবু্‌, আমি তো বাবাকে এমন কিছু খেতে দিইনি। যাতে ওঁর শরীর খারাপ হতে পারে।’

ডাক্তার কোনো কথা বললেন না‌, ওষুধের প্রেসক্রিপশন ও পথ্যের নির্দেশ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন–’কেমন থাকেন আমি টেলিফোন করে খবর নেব।’

ডাক্তার চলে যাবার পর বেণীমাধব‌, আরতির পানে চেয়ে বললেন—’বৌমা‌, আমার পথ্য তৈরি করার ভার তোমার ওপর রইল।’

আরতি বিজয়োল্লাস চেপে বলল–’হ্যাঁ বাবা।’

তিন চার দিনের মধ্যে বেণীমাধব সেরে উঠলেন‌, তাঁর পেট ধাতস্থ হলো। পথ্য ছেড়ে তিনি স্বাভাবিক খাদ্য খেতে লাগলেন। আরতিই তাঁর জন্যে রান্না করে চলল।

কিন্তু বেণীমাধবের মন শান্ত নয়। চিরদিন নানা লোকের সঙ্গে নানা কাজে দিন কাটিয়েছেন‌, এখন তাঁর জীবন বৈচিত্র্যহীন। সকালে মেঘরাজ তাঁর দাড়ি কামিয়ে দেয়‌, তিনি স্নানাদি করে চা খেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসেন। তাতে ঘন্টাখানেক কাটে। তারপর রেডিও চালিয়ে খানিকক্ষণ গান শোনেন। গান বেশিক্ষণ ভাল লাগে না‌, রেডিও বন্ধ করে বই এবং সাময়িক পত্রিকার পাতা ওলটান।

একদিন কলকাতার পুরনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যায়। টেলিফোন ডিরেকটরি খুঁজে তাঁদের নাম বার করেন‌, টেলিফোন করে কাউকে পান না কাউকে পান; কিছুক্ষণ পুরনো কালের গল্প হয়। এগারোটার পর আরতি ভাতের থালা নিয়ে আসে। আহারের পর তিনি ঘন্টাখানেক বিছানায় শুয়ে দিবানিদ্রায় কাটান।

বিকেলবেলা ঝিল্লী কিংবা লাব্রণি আসে‌, তাদের সঙ্গে খানিক গল্প করেন। লাবণিকে বলেন–’কেমন নাচতে শিখেছিস দেখা।’

লাবনি বলে—’আমি এখনো ভাল শিখিনি দাদু‌, ভাল শিখলে তোমাকে দেখাব।’

বেণীমাধব বলেন–’তোর মাস্টার ভাল শেখাতে পারে?’

লাবণি গদগদ হয়ে বলে—’খুব ভাল শেখাতে পারেন। এত ভাল যে—? লজ্জা পেয়ে সে অর্ধপথে থেমে যায়।

বেণীমাধব প্রশ্ন করলেন–’কত বয়স মাস্টারের?’

‘তা কি জানি! হবে ছব্বিশ সাতাশ। যাই‌, মা ডাকছে।’ লাবনি তাড়াতাড়ি চলে যায়। সূৰ্য্যস্তের পর বেণীমাধব খোলা ছাদে অনেকক্ষণ পায়চারি করেন। ইচ্ছে হয় রবীন্দ্র সরোবরে গিয়ে লোকজনের মধ্যে খানিক বেড়িয়ে আসেন; কিন্তু তিনতলা সিঁড়ি ভাঙা তাঁর পক্ষে কষ্টকর‌, তাই ছাদে বেড়িয়েই তাঁর ব্যায়াম সম্পন্ন হয়।

রাত্ৰি ন’টার সময় আহার সমাপন করে তিনি শয়ন করেন। এই তাঁর দিনচযা। মেঘরাজ হামোহাল তাঁর কাছে হাজির থাকে; কখনো ঘরের মধ্যে কখনো দোরের বাইরে। তিনি শয়ন করলে মেঘরাজ নীচে গিয়ে আহার সেরে আসে; বেণীমাধবের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে দরজার বাইরে আগড় হয়ে বিছানা পেতে শোয়।

এইভাবে দিন কাটছে। একদিন এক অধ্যাপক বন্ধুকে টেলিফোন করে বেণীমাধবের মুখ গভীর হলো। টেলিফোন রেখে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন‌, তারপর মেঘরাজকে ডেকে বললেন—’তুমি নীচে গিয়ে মকরন্দকে ডেকে আনো।’

কয়েক মিনিট পরে মকরন্দ এসে দাঁড়াল। চাকরের মুখে তলব পেয়ে সে খুশি হয়নি‌, অপ্রসন্ন মুখে প্রশ্ন নিয়ে পিতামহের মুখের পানে চাইল। বেণীমাধব কিছুক্ষণ তার উষ্ণখুষ্ক চেহারার পানে তাকিয়ে রইলেন‌, তারপর জিজ্ঞেস করলেন–’তুমি কলেজে ঢুকেছ‌, লেখাপড়া কেমন হচ্ছে?’

মকরুন্দর মুখ ভ্রূকুটি-গভীর হলো—’হচ্ছে এক রকম।’

বেণীমাধব বললেন—’শুনলাম তুমি ক্লাসে যাও না‌, দল পাকিয়ে পলিটিক্স করে বেড়াও‌, এ কথা সত্যি?’

উদ্ধত স্বরে মকরন্দা বলল-‘কে বলেছে?’

মাধব কড়া সুরে বললেন-কে বলেছে সে কথায় তোমার দরকার নেই। কথাটা সত্যি কিনা?

‘হ্যাঁ সত্যি।’ মকরন্দ চোখ লাল করে ঠাকুরদার পানে চেয়ে রইল।

‘বটে!’ বেণীমাধবের চোখেও রাগের ফুলকি ছিটকে পড়ল–’তুমি বেয়াদবি করতে শিখেছি।–মেঘরাজ!’

মেঘরাজ দোরের বাইরে ছিল‌, ঘরে ঢুকল। বেণীমাধবী আঙুল দেখিয়ে বললেন—’এই ছোঁড়ার কান ধরে গালে একটা থাবড়া মারো‌, তারপর ঘাড় ধরে বার করে দাও।’

মেঘরাজ সিপাহী ছিল‌, সে হুকুমের চাকর। যথারীতি মকরন্দর কান ধরে গালে চড় মারল। মকরন্দর মনে যতই ধৃষ্টতা থাক, মেঘরাজের সঙ্গে হাতাহাতি করবার সাহস বা দৈহিক শক্তি তার নেই‌, সে ধাক্কা খেতে খেতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কথাটা আর চাপা রইল না। অজয় আর আরতি ছুটে এসে বেণীমাধবের কাছে ক্ষমা চাইল। বেণীমাধব গভীর হয়ে রইলেন‌, শেষে বললেন–‘বংশে একটা মাত্র ছেলে‌, সে বেল্লিক বেয়াদব হয়ে উঠেছে। দোষ তোমাদের‌, তোমারা ছেলে শাসন করতে জানো না।’

ব্যাপারটা আর বেশিদূর গড়াল না।

তারপর একদিন বিকেলবেলা সনৎ এল মামার সঙ্গে দেখা করতে। সনৎ আর নিখিল মাঝে মাঝে এসে মামার কাছে বসে‌, সসন্ত্রমে মামার কুশল প্রশ্ন করে চলে যায়। আজ সনৎ তার ক্যামেরা নিয়ে এসেছে‌, বলল–’মামা‌, আপনার একটা ছবি তুলব।’

বেণীমাধব হেসে বললেন—’আমি বুড়ো মানুষ‌, আমার ছবি তুলে কি হবে।’

সনৎ বলল–’আমার অ্যালবামে রাখব।’

‘কিন্তু এখন আলো কমে গেছে‌, এ আলোতে ছবি তোলা যাবে?’

‘যাবে। আমি ফ্ল্যাশ বালব এনেছি।’

‘বেশ‌, তোলো।’ বেণীমাধব একটি হেলান দেওয়া চেয়ারে বসলেন।

সনৎ ছবি তোলার উপক্রম করছে এমন সময় নিখিল এসে দাঁড়াল। সনৎ এদিক ওদিক ঘুরে শেষে একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে ছবি তুলল; বালবটা একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল। নিখিল বলল-সনৎদা‌, ছবি তৈরি হলে আমাকে একখানা দিও‌, আমি কাগজে ছাপাব। মামা কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন‌, কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে আছেন‌, খবরটা প্রকাশ করা দরকার।’

বেণীমাধব মনে মনে ভাগনেদের ওপর খুশি হলেন।

0 Shares