বেণীসংহার

পরদিন সনৎ ছবি এনে বেণীমাধবকে দেখাল। ছবিটি ভাল হয়েছে; বেণীমাধবের জরাক্রান্ত মুখ শিল্পীর নৈপুণ্যে শান্ত কোমল ভােব ধারণ করেছে। সনৎ যে কৌশলী শিল্পী তাতে সন্দেহ নেই।

বেণীমাধব বললেন—’বেশ হয়েছে। এটাকে বাঁধিয়ে কোথাও টাঙিয়ে রাখলেই হবে।’

সনৎ বলল–’আমি এনলার্জ করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে এনে দেব। নিখিলকে এক কপি দিয়েছি‌, সে কাগজে ছাপবে।’

অতঃপর বেণীমাধবের কর্মহীন মন্থর দিনগুলি কাটছে। সনৎ বড় ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। কাগজে তাঁর ছবি ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় বেরিয়েছে। এরকম অবস্থায় বৃদ্ধ বয়সে মানুষ শান্তি ও স্বচ্ছন্দতা লাভ করে। কিন্তু বেণীমাধবের মনে শান্তি স্বচ্ছন্দতা আসছে না। ছেলে ও মেয়ের পরিবারের সঙ্গে একটানা সান্নিধ্য তিনি উপভোগ করতে পারছেন। না। পারিবারিক জীবনের স্বাদ ভুলে গিয়ে যাঁরা দীর্ঘকাল একলা পথে চলেছে তাঁদের বোধহয় এমনিই হয়।

ওদিকে ছেলে এবং মেয়ের পরিবারেও সুখ নেই; গায়ত্রীর মেজাজ সর্বদাই তিরিক্ষি হয়ে থাকে। গঙ্গাধর সারা দিন বসে একা একা তাস খেলে‌, সলিটেয়ার খেলা; সন্ধ্যের সময় চুপি চুপি বেরিয়ে যায়‌, আবার বেশি রাত্রি হবার আগেই ফিরে আসে। অজয় ক্লাবে গিয়ে অনেক রাত্রি পর্যন্ত আডা জমাত কিংবা রিহাসেল দিতা; এটা ছিল তার জীবনের প্রধান বিলাস। এখন তাকে রাত্রি ন’টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হয়‌, কারণ কর্তার হুকুম-নাটার পর সদর দরজা খোলা থাকবে না। ন’টার পর বাড়ি ফিরে দোর ঠেলাঠেলি করলে তেতলায় শব্দ যাবে‌, সেটা বাঞ্ছনীয় নয়। সকলেরই একটা চোখ এবং একটা কান তেতলার দিকে সতর্ক হয়ে থাকে। আরতি যদিও সর্বদাই শ্বশুরকে খুশি করবার চেষ্টা করছে‌, তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।

নিশ্চিন্ত আছে কেবল দোতলায় দু’টি মেয়ে‌, লাব্রণি আর ঝিল্লী্‌্‌, এবং নীচের তলায় সনৎ ও নিখিল। ঝিল্লী আর লাবণির বয়স মাত্র আঠারো‌, বিষয়বুদ্ধি এখানো পরিপক্ক হয়নি। সনৎ আর নিখিলের বেলায় পরিস্থিতি অন্যরকম; মামা তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন বট, কিন্তু তারা মামার কাছে অর্থ-প্রত্যাশী নয়। সনতের গোপন নৈশাভিসারের কথা বেণীমাধব জানতে পারবেন। এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। নিখিলের ওসব দোষ নেই‌, উপরন্তু কয়েক মাস থেকে সে এক নতুন ব্যাপারে মশগুল হয়ে আছে।

বেণীমাধব কলকাতায় এসে বসবার আগে একদিন নিখিল হঠাৎ ডাকে একটা চিঠি পেল‌, খামের চিঠি। তাকে চিঠি লেখবার লোক কেউ নেই‌, সে একটু আশ্চর্য হয়ে চিঠি খুলল। এক পাতা কাগজের ওর দু’ছত্র লেখা আছে—

আমি একটি মেয়ে। তোমাকে ভালবাসি।–

চিঠির নীচে লেখিকার নাম নেই।

নিখিল কিছুক্ষণ বোকার মত চেয়ে রইল। তারপর তার মুখে গদগদ হাসি ফুটে উঠল। একটা মেয়ে তাকে ভালবাসে! বা রে! ভারি মজা তো!

কিন্তু কে মেয়েটা?

নিখিল খামের ওপর পোস্ট অফিসের সীলমোহর পরীক্ষা করল; সীলমোহরের ছাপ জেবড়ে গেছে‌, তবু কলকাতায় চিঠি ডাকে দেওয়া হয়েছে এটুকু বোঝা যায়। কলকাতার মেয়ে। কে হতে পারে? চিঠিই বা লিখলি কেন? ভালবাসা জানাবার আরো তো অনেক সোজা উপায় আছে। মুখে বলতে লজ্জা হয়েছে তাই চিঠি! কিন্তু নিজের নাম লেখেনি কেন?

নিখিল অনেক মেয়েকে চেনে। তার অফিসেই তো গোটা দশেক আইবুড়ো মেয়ে কাজ করে। তাছাড়া বন্ধুবান্ধবের বোনেরা আছে। মেয়েরা তার চটুল রঙ্গপ্রিয় স্বভাবের জন্যে তার প্রতি অনুরক্ত‌, তাকে দেখলেই তাদের মুখে হাসি ফোটে। কিন্তু কেউ তাকে চুপিচুপি ভালবাসে বলেও তো মনে হয় না। আর এত লজ্জাবতীও কেউ নয়।

হাতে চিঠি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিখিল এইসব ভাবছে এমন সময় পিছন দিক থেকে লাবণর গলা শুনতে পেল–’কি নিখিল কাকা‌, কার চিঠি পড়ছ?’

নিখিল ফিরে দাঁড়াল। ঝিল্লী আর লাব্রণি কখন দোতলা থেকে নেমে এসেছে; তাদের হাতে কয়েকখানা বই। তারা একসঙ্গে লাইব্রেরিতে যায় বই বদল করতে।

নিখিল হাত উঁচুতে তুলে নাড়তে নাড়তে বলল—’কার চিঠি! একটি যুবতী আমাকে চিঠি লিখেছে।’ বলে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।

লাবনি বলল—’যুবতী লিখেছে! কী লিখেছে?’

নিখিল বলল—’হুঁ হুঁ, দারুণ ব্যাপার‌, গুরুতর ব্যাপার। লিখেছে সে আমাকে ভালবাসে।’

লাবণি আর ঝিল্লী অবাক হয়ে পরস্পরের পানে তাকাল‌, তারপর হেসে উঠল। লাবণি বলল–’কোন গুল মারছ নিখিল কাকা। তোমাকে আবার কোন যুবতী ভালবাসবে?’

নিখিল চোখ পাকিয়ে বলল–’কেন‌, আমাকে কোনো যুবতী ভালবাসতে পারে না! দেখেছিস আমার চেহারাখানা।’

‘দেখেছি। এখন বলো কার চিঠি।’

‘বললাম না যুবতীর চিঠি!’

ঝিল্লী প্রশ্ন করল–’যুবতীর নাম কি?’

নিখিল মাথা চুলকে বলল–’নাম! জানি না। চিঠিতে নাম নেই।’

বিল্লী আর লাব্রণি আবার হেসে উঠল। লাব্রণি বলল–’তোমার একটা কথাও আমরা বিশ্বাস করি না। নিশ্চয় পাওনাদারের চিঠি।’

‘পাওনাদারের চিঠি! তবে এই দ্যাখ।।’ নিখিল চিঠিখানা তাদের নাকের সামনে ধরল।

দু’জনে চিঠি পড়ল। লাব্রণি বলল—’হঁ। কিন্তু চিঠি পড়েও বিশ্বাস হচ্ছে না যে‌, একটা মেয়ে তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছে। আমার মনে হয়। কেউ তোমার ঠ্যাং ধরে টেনেছে‌, মানে লেগ-পুলিং।’

নিখিল একটু গরম হয়ে বলল–’যা যা‌, তোরা এসব কী বুঝবি! এসব গভীর ব্যাপার। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে‌, শুনেছিস কখনো?’

‘শুনেছি।’ ঝিল্লী আর লাব্রণি মুখ টিপে হাসতে হাসতে চলে গেল।

এর পর থেকে যখনি কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় নিখিল উৎসুক চোখে তার পানে তাকায় কিন্তু কোনো সাড়া পায় না। তার মন আরো ব্যগ্র হয়ে ওঠে। কে মেয়েটা? নিশ্চয় তার পরিচিত। তবে এমন লুকোচুরি খেলছে। কেন?

0 Shares