বেণীসংহার

মাসখানেক পরে দ্বিতীয় চিঠি এল। এবার একটু বড়—

আমি একটি মেয়ে। তোমাকে ভালবাসি। আমাকে চিনতে পারলে না?

চিঠি পেয়ে নিখিলের মন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। লাব্রণি আর ঝিল্লী হাতের কাছে নেই‌, কিন্তু কাউকে না বলেও থাকা যায় না‌, তাই সে ঝোঁকের মাথায় সনতের ঘরে গেল।

সনতের ঘরটি বেশ বড়; এই একটি ঘরের মধ্যে তার একক জীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী সঞ্চিত আছে। এক পাশে খাটের ওপর পুরু গদির বিছানা পাতা; খাটের শিথানের কাঠের ওপর বিচিত্র জাফরির কারুকার্য। ঘরের অন) পাশে জানালার সামনে দেরাজযুক্ত টেবিল‌, তার ওপর ফটোগ্রাফির নানা সরঞ্জাম সাজানো; তিনটি হাতে-তোলা ক্যামেরা‌, তার মধ্যে একটি সিনো-ক্যামেরা। ঘরে একটি আয়নার ব্লকবাটযুও আলমারিও আছে। ঘরটি ছিমছাম ফিটফাঁট‌, দেখে বোঝা যায়। সনৎ গোছালো এবং শৌখিন মানুষ।

নিখিল যখন ঘরে ঢুকাল তখন সনৎ টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে একটা ক্যামেরার যন্ত্রপাতি খুলে পরীক্ষা করছিল‌, চোখ তুলে চেয়ে আবার কাজে মন দিল। নিখিল গম্ভীর মুখে বলল–’সনৎদা‌, গুরুতর ব্যাপার।’

সনৎ একবার চকিতে চোখ তুলাল‌, বলল–’তোমার জীবনে গুরুতর ব্যাপার কী ঘটতে পারে! আমাশা হয়েছে?’

নিখিল বলল–’আমাশা নয়‌, একটা মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে।’

এবার সনৎ বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। শেষে বলল–’আমাশা নয়‌, দেখছি তোমার মাথার ব্যারাম হয়েছে। বাংলা দেশে এমন মেয়ে নেই যে তোমার প্রেমে পড়বে।’

নিখিল বলল–’বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখা চিঠি। মাসখানেক আগে আর একটা পেয়েছি।’

চিঠি নিয়ে সনৎ একবার চোখ বুলিয়ে ফেরত দিল‌, প্রশ্ন করল—’মেয়েটাকে চেনো না?’

‘না‌, সেই তো হয়েছে মুশকিল।’

সনৎ একটু চুপ করে রইল‌, তারপর বলল—’বুঝেছি! তোমার চেনা-শোনার মধ্যে কোনো কালো কুচ্ছিত মেয়ে আছে?’

নিখিল হেসে বলল—’বেশির ভাগই কালো কুচ্ছিত সনৎদা।’

সনৎ বলল–’তাহলে ওই কালো কুচ্ছিত মেয়েদের মধ্যেই একজন বেনামী চিঠি লিখে রহস্য সৃষ্টি করছে। তোমাকে তাতাবার চেষ্টা করছে। তোমার ঘটে যদি বুদ্ধি থাকে ওদের এড়িয়ে চলবে।’

কিন্তু এড়িয়ে চলার ক্ষমতা নিখিলের নেই। তাছাড়া কালো কুচ্ছিত মেয়ের প্রতি তার বিরাগ নেই। তার বিশ্বাস কালো কুচ্ছিত মেয়েরা ভালো বৌ হয়। সে চতুৰ্থণ আগ্রহে অনামা প্রেমিকাকে খুঁজে বেড়াতে লাগল।

তারপর বেণীমাধব এলেন‌, বাড়ির আবহাওয়া বদলে গেল। কিন্তু নিখিলের কাছে নিয়মিত চিঠি আসতে লাগল। তৃতীয় চিঠিতে লেখা হয়েছে—

আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে চিনতে পারলে না? আমি কিন্তু সুন্দর মেয়ে নই।

নিখিল ভাবল‌, সনৎদা ঠিক ধরেছে। কিন্তু সে দমল না। তার জীবনে এক অভাবিত রোমান্স এসেছে; একে তুচ্ছ করার সাধ্য তার নেই।

ওদিকে বেণীমাধব হগুপ্ত তিনেক পুত্রবধূর হাতের রান্না খেয়ে বেশ ভালই রইলেন। তারপর একদা গভীর রাত্রে ওঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল; পেটে দারুণ যন্ত্রণা। যাতনায় ছটফট করতে করতে মেঘরাজকে ডাকলেন। বেণীমাধব দুহাতে পেট চেপে ধরে বসেছিলেন‌, বললেন—’মেঘরাজ‌, শীগগির ডাক্তার সেনকে ফোন করো‌, বলো আমি পেটের যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি‌, এখনি যেন আসেন।’

মেঘরাজ ফোন করল‌, আধা ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার সেন এলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করে চিকিৎসা আরম্ভ করলেন। পেটের প্রদাহ। কিন্তু সহজে উপশম হলো না; রাত্ৰি পাঁচটা পর্যন্ত ধস্তাধস্তির পর ব্যথা শান্ত হলো। বেণীমাধব নিজীব দেহে বিছানায় শুয়ে বিস্ফারিত চোখে ডাক্তারের পানে চাইলেন—’ডাক্তার‌, কেন এমন হলো বলতে পার?’

ডাক্তার গম্ভীর মুখে ক্ষণেক চুপ মেরে রইলেন‌, তারপর অনিচ্ছাভরে বললেন-‘নিঃসংশয়ে কলামুক্ত। অ্যালারজি হতে পারে‌, শূল ব্যথা হতে পারে‌, কিংবা-’

‘কিংবা-?’

‘কিংবা বিষের ক্রিয়া। —আমি বলি কি‌, আপনি কিছুদিন আমার নার্সিং হোমে থাকবেন। চলুন। চিকিৎসা পথ্য দুইই হবে।’

বেণীমাধবের কিন্তু নার্সিং হোমে বিশ্বাস নেই; তাঁর ধারণা যারা একবার নার্সিং হোমে ঢুকেছে। তারা আর ফিরে আসে না। তিনি যথাসম্ভব দৃঢ়স্বরে বললেন—’না ডাক্তার‌, আমি বাড়িতেই থাকব।’

ডাক্তার উঠলেন–’আচ্ছা‌, এখন চলি। যদি আবার কোনো গণ্ডগোল হয় তৎক্ষণাৎ খবর দেবেন। কাল আর পরশু স্রেফ দই খেয়ে থাকবেন।’

মেঘরাজ ডাক্তারের সঙ্গে নীচে পর্যন্ত গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল‌, ডাক্তার চলে গেলেন। মেঘরাজ দরজা বন্ধ করে আবার ওপরে উঠে এল। বাড়ির অন্য মানুষগুলো তখনো ঘুমোচ্ছে‌, ডাক্তারের আসা-যাওয়া জানতে পারল না।

বিছানায় শুয়ে বেণীমাধব তখন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে চিন্তা করছিলেন। দুরূহ দুৰ্গম চিন্তা। পুত্ৰাদপি ধনভাজাং ভীতি। একবার নয়‌, দু-দু’বার এই ব্যাপার হলো…ছেলে আর মেয়ে অপেক্ষা করে আছে। আমি কবে মরব…আমি মরছি না দেখে অধীর হয়ে উঠেছে! কিন্তু ছেলে মেয়ে জামাই পুত্রবধূ এমন কাজ করতে পারে? কেন করবে না‌, সংসারে টাকাই খাঁটি জিনিস‌, আর যা-কিছু সব ভুয়ো। ডাক্তারের মনেও সন্দেহ ঢুকেছে..

সকাল সাতটার সময় বেণীমাধব বিছানায় উঠে বসলেন‌, মেঘরাজ তাঁর দাড়ি কামিয়ে দিল। তারপর তিনি তার হাতে টাকা দিয়ে বললেন-যাও‌, বাজার থেকে দই কিনে নিয়ে এসো। এক  সের ভাল দই।‘

টাকা নিয়ে মেঘরাজ চলে গেল। সে সৈনিক‌, হুকুম তামিল করে‌, কথা বলে না। তার মুখ দেখেও কিছু বোঝা যায় না।

সাড়ে সাতটার সময় আরতি এল‌, তার সঙ্গে বিগ্ন ট্রের ওপর চা ও প্রাতরাশ নিয়ে এসেছে। ঘরে ঢুকেই আরতি চমকে উঠল; বেণীমাধব বিছানায় বসে একদৃষ্টি তার পানে চেয়ে আছেন। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—’বাবা–’

0 Shares