বেণীসংহার

সনৎ তখন ক্যামেরা নিয়ে বেরুচ্ছিল। নিখিল বলল–’এ কি সনৎদা‌, সাজিত-গুজ্জিত হয়ে চলেছ কোথায়?’

সনৎ বলল–’গ্র্যান্ড হোটেলে পার্টি আছে। হাতে ওটা কি?’

নিখিল চিঠি তুলে ধরে বলল–’আবার চিঠি পেয়েছি‌, পড়ে দেখ। এ মেয়ে কালো কুচ্ছিত হোক‌, কানা খোঁড়া হোক‌, একেই আমি বিয়ে করব।’

সনৎ চিঠি পড়ে বলল–’হুঁ, কানা-খোঁড়াই মনে হচ্ছে। তা বিয়ে করতে চাও কর না‌, কে তোমাকে আটকাচ্ছে। কিন্তু তার আগে মেয়েটাকে খুঁজে বার করতে হবে তো।’

সনৎ নিজের ঘরে তালা বন্ধ করল। মেঘরাজের ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখল মেদিনী ঘরে রয়েছে। সনৎ একবার দাঁড়িয়ে বলল–’মেদিনী‌, আজ আমার ফিরতে দেরি হবে। একটা পার্টিতে ফটো তুলতে যাব‌, কখন ফিরব ঠিক নেই। আমি দোরে টোকা দিলে দোর খুলে দিও।‘

মেদিনী নিজের দোরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে এখন বাংলা ভাষা বেশ বুঝতে পারে‌, কিন্তু বলতে পারে না। চোখ নীচু করে সে নম্রস্বরে বলল—’জি।’

সনৎ বেরিয়ে যাওয়ার পর নিখিল মেদিনীর কাছে এসে দাঁড়াল‌, বলল—’মেদিনী‌, তুম জানতা হ্যায়‌, একঠো লেড়কি হামকে ভালবাসামে গির গিয়া। হাম উসকে শান্দি করেগা।’

মেদিনীর চোখে কৌতুক নেচে উঠল‌, সে আচল দিয়ে হাসি চাপা দিতে দিতে দোর ভেজিয়ে দিল।

মেদিনী আসার পর থেকে গঙ্গাধরের চিত্ত চঞ্চল হয়েছে। বয়সটা খারাপ; যৌবন বিদায় নেবার আগে মরণ-কামড় দিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গাধর যখন বিকেলবেলা বাইরে যায় তখন মেদিনীর দোরের দিকে তাকাতে তাকাতে যায়‌, কদাচ মেদিনীর সঙ্গে চোখাচৌখি হলে চোখ সরিয়ে নেয় না‌, একদৃষ্টি চেয়ে থাকে; মেদিনী চৌকাঠে ঠেস দিয়ে চোখ নীচু করে তার দৃষ্টিপ্রসাদ গ্রহণ করে। পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টিতে সে অভ্যস্ত।

অজয়ের ভাবভঙ্গী একটু অন্যরকম। সে যেন মেদিনীকে দেখে বাৎসল্য স্নেহ অনুভব করে; তার সঙ্গে পাটিচটি গল্প করে‌, তার দেশের খবর নেয়। মেদিনী সরলভাবে কথা বলে‌, মনে মনে হাসে।

মকরন্দ প্রথমদিকে কিছুদিন মেদিনীকে দেখেনি। একবার তিন-চারদিন সে বাড়ি ফিরল না; জানা গেল পুলিস ভ্যান লক্ষ্য করে ইট ছোঁড়ার জন্যে পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে। চতুর্থ দিন সে মুক্তি পেয়ে রাত্রি সাড়ে দশটার সময় এসে বাড়ির সদর দরজায় ধাক্কা দিল। মেদিনী গিয়ে দোর খুলল। মকরন্দর চেহারা শুকনো‌, জামা ছেড়া‌, চুল উষ্ণখুষ্ক; সে তীব্র দৃষ্টিতে মেদিনীর পানে চেয়ে রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করল—’তুমি কে?’

‘আমি মেদিনী।’

‘অ-মেঘরাজের বৌ।’ কুটিলভাবে মুখ বিকৃত করে সে মেদিনীকে আপাদমস্তক দেখল‌, তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেল। মেদিনী জানত মকরুন্দ কে‌, সে মুখ টিপে হেসে নিজের ঘরে ফিরে গেল।–

তিন মাস কেটে যাবার পরও যখন বেণীমাধবের পেটের আর কোনো গণ্ডগোল হলো না তখন তিনি নিঃসংশয়ে বুঝলেন তাঁর পেটের কোনো দোষ নেই‌, হজম করার শক্তি অক্ষুন্ন আছে। পুত্রবধূ এবং মেয়ের প্রতি তাঁর সন্দেহ নিশ্চয়তায় পরিণত হলো। তারপর একদা গভীর রাত্রে বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। কে যেন ছুরি দিয়ে পেঁচিয়ে পেচিয়ে তার গলা কাটছে।

তারপর তিনি আর ঘুমোতে পারলেন না। বাকি রাত্রিটা চিন্তা করে কাটালেন। মৃত্যুভয়ে জড়িত। ঐহিক চিন্তা।

পরদিন বেলা সাড়ে দশটার সময় তিনি তাঁর সলিসিটারকে টেলিফোন করলেন—’সুধাংশুবাবু্‌, আমি উইল করতে চাই। বেশি নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই‌, আপনি একবার আসবেন?

বেণীমাধব পুরনো মক্কেল‌, মালদার লোক। সুধাংশুবাবু বললেন—’বিকেলবেলা যাব।’

বিকেলবেলা সুধাংশুবাবু এলেন। দোর বন্ধ করে দু’জনে প্রায় দেড় ঘন্ট উইলের শতাদি আলোচনা করলেন; সুধাংশুবাবু অনেক নোট করলেন। শেষে বললেন—‘পরশু আমি উইল তৈরি করে নিয়ে আসব‌, আপনি উইল পড়ে দস্তখত করে দেবেন। দু’জন সাক্ষীও আমি সঙ্গে আনব।’–

সন্ধ্যের পর সনৎ আর নিখিল বেণীমাধবের কাছে এসে বসল‌, কুশল প্রশ্ন করল। মেদিনী পাশের ঘরে রান্না করছিল; বেণীমাধব ভাগনেদের চা ও আলুভাজা খাওয়ালেন।

ওরা চলে যাবার পর বেণীমাধব মেঘরাজকে ডেকে বললেন-‘‘দোতলা থেকে সকলকে ডেকে নিয়ে এসে।’

দোতলায় মকরন্দ ছাড়া আর সকলেই ছিল‌, সমান পেয়ে ছুটে এল। ঝিল্লী আর লাবণিও এল। বেণীমাধব খাটের ধারে বসেছিলেন‌, দুই নাতনীকে ডেকে নিজের দু’ পাশে বসলেন‌, তারপর ছেলে-বৌ মেয়ে-জামাই-এর পানে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললেন–’আমি উইল করতে দিয়েছি। উইলের ব্যবস্থা আগে থাকতে তোমাদের জানিয়ে দিতে চাই।’

সকলে সশঙ্ক মুখে চেয়ে রইল। বেণীমাধব ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন—’আমার মৃত্যুর পর আমার নগদ সম্পত্তি তোমরা হতে পাবে না। অ্যানুইটির ব্যবস্থা করেছি; তোমরা এখন যেমন মাসহারা পাচ্ছ তেমনি পাবে। কোনো অবস্থাতেই যাতে তোমাদের অর্থকষ্ট না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে মাসহারার টাকার অঙ্ক ধার্য করেছি। বাড়িটা যতদিন তোমরা বেঁচে থাকবে ততদিন সমান ভাগ করে ভোগ করবে‌, বিক্রি করতে পারবে না।’

চারজনে মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে রইল। বেণীমাধব দুই নাতনীর কাঁধে হাত রেখে বললেন–’ঝিল্লী আর লাবণির জন্যে আমি আগে থেকেই মেয়াদী বীমা করে রেখেছি‌, একুশ বছর বয়স পূর্ণ হলে ওরা প্রত্যেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে। তাছাড়া আমি ঠিক করেছি। ওদের বিয়ে দিয়ে যাব। তোমাদের মেয়ের বিয়ের ভাবনা ভাবতে হবে না। লাবণির জন্যে একটি ভাল পাত্র আছে; ছেলেটি মিলিটারিতে লেফটেনেন্ট! ঝিল্লীর জন্যে মনের মত পাত্র এখনো পাইনি‌, পেলেই একসঙ্গে দু’জনের বিয়ে দেব।’ তাঁর মুখে একটু প্রসন্নতার ভাব এসেছিল‌, আবার তা মুছে গেল; তিনি ভ্রূকুটি করে বললেন—’মকরুন্দকেও আলাদা পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যাব ভেবেছিলাম‌, কিন্তু সে বড় অসভ্য বেয়াদব হয়ে দাঁড়িয়েছে‌, তাকে কিছু দেব না।’

0 Shares