বেণীসংহার

বেণীমাধব চুপ করলেন‌, তাঁর শ্রোতারাও চুপ করে রইল; কারুর মুখে কথা নেই। শেষে গঙ্গাধর একটু কেশে অস্পষ্টভাবে বলল—’আপনার সম্পত্তি আপনি যেমন ইচ্ছে ব্যবস্থা করুন‌, আমাদের বলবার কিছু নেই। তবে টাকার দর‌, আজ এক রকম কাল এক রকম–’

গায়ত্রী স্বামীর কথায় বাধা দিয়ে ভারী গলায় বলল–’বাবা‌, তুমি যা দেবে তাই মাথা পেতে নেব। উইল কি সই হয়ে গেছে?’

বেণীমাধব কারুর দিকে তাকালেন না‌, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন–উকিলকে উইল তৈরি করতে দিয়েছি‌, কাল পরশু সই দস্তখত হবে। হ্যাঁ‌, একটা শর্তের কথা তোমাদের বলা হয়নি। উইলের শর্ত থাকবে‌, যদি আমার অপঘাত মৃত্যু হয় তাহলে তোমরা কেউ আমার এক পয়সা পাবে না‌, সব সম্পত্তি পাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।’

এই কথা শুনে সকলে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল‌, তারপর আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাত্রি হলো। যথাসময়ে বেণীমাধব নৈশাহার সম্পন্ন করে শয্যা নিলেন। মেঘরাজ ও মেদিনী পাশের ঘরে খাওয়াদাওয়া করল; মেঘরাজ সামনের দরজা ভেজিয়ে দরজা আগলে বিছানা পাতল‌, মেদিনী নিজের ঘরে গেল।

ওদিকে দোতলায়। থমথমে ভাব। লাবণির নাচের মাস্টার এসেছিল‌, কিন্তু বাড়িতে কারুর নাচের প্রতি রুচি নেই। পরাগ আর লাব্রণি আড়ালে কথা বলল‌, তারপর চুপিচুপি নিঃশব্দে সিনেমা দেখতে চলে গেল। কেউ তাদের যাওয়া লক্ষ্য করল। কিনা সন্দেহ।

নিখিল সন্ধ্যের পরই কাজে চলে গিয়েছিল; সে নিশাচর মানুষ‌, সারা রাত কাজ করে‌, সকালবেলা ফিরে আসে।

রাত্রি আন্দাজ ন’টার সময় সনৎ ক্যামেরা নিয়ে বেরুল‌, মেদিনীর দোরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল—’মেদিনী‌, আমি বর্ধমানে যাচ্ছি‌, কাল সকালে সেখানে একটা নাচগানের মজলিশ আছে। কাল বিকেলের দিকে কোনো সময় ফিরব। আমার জন্যে আজ রাত্রে তোমাকে দোর খুলতে হবে না।’ বলে একটু হাসল।

মেদিনী ক্ষণকাল তার চোখে চোখ রেখে বলল–’জি।’

সনৎ চলে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে মকরন্দ এল‌, মেদিনীকে কড়া সুরে বলল–’দোর বন্ধ করে দাও। রাত্রে কেউ যদি বাইরে থেকে এসে আমার খোঁজ করে‌, বলবে আমি বাড়ি নেই।’ উত্তরের অপেক্ষা না করে সে ওপরে চলে গেল। মেদিনী সদর দরজায় খিল লাগাল।

তারপর বাড়ির ওপর রাত্রির রহস্যময় যবনিকা নেমে এল।

পরদিন ভোরবেলা মেদিনী সদর দরজা খুলতে গিয়ে দেখল, কবাট ভেজানো আছে কিন্তু খিল খোলা। সে ভুরু কুঁচকে একটু ভাবল‌, তারপর কবাট একটু ফাঁক করল; বাইরে নিখিলকে দেখা গেল‌, সে কাজ শেষ করে ফিরছে। মেদিনীর সঙ্গে চোখাচে্যুখি হতেই সে হেসে বলল–’তোমরা কাম শুরু হুয়া হামারা কাম শেষ হুয়া। এবার খুব ঘুমায়গা।’

নিখিল নিজের ঘরে চলে গেল। মেদিনী দরজা ফাঁক করে রাখল‌, কারণ দোতলায় বি কাজ করতে আসবে। তারপর সে কর্তার চা তৈরি করার জন্যে সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় চলল।

মিনিটখানেক কাটতে না কাটতে তিনতলা থেকে স্ত্রীকণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ এল‌, তারপর ধাপ করে শব্দ। নিখিল তার ঘরে গায়ের জামা খুলে গেঞ্জি খোলবার উপক্রম করছিল‌, তীব্র চীৎকার শুনে সেই অবস্থাতেই ওপরে ছুটিল। দোতলা থেকেও সকলে বেরিয়ে এসেছিল‌, সকলে প্ৰায় একসঙ্গে তেতলায় গিয়ে পৌঁছল। তারপর বেণীমাধবের দোরের সামনে ভয়াবহ দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মেঘরাজ বিছানার ওপর ঊর্ধ্বমুখে পড়ে আছে‌, তার গলা এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত কাঁটা; বালিশ এবং বিছানার ওপর পুরু হয়ে রক্ত জমেছে। মেদিনী তার পায়ের দিকে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছে।

কিছুক্ষণ কারুর মুখ দিয়ে কথা সরল না‌, তারপর নিখিল চেচিয়ে উঠল–’মামা-মামা বেঁচে আছেন তো?’

গায়ত্রী, আরতি এবং ঝিল্লী কেঁদে উঠল‌, অজয় এবং গঙ্গাধর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল; কারুর যেন নড়বার শক্তি নেই। নিখিল তখন মেঘরাজকে ডিঙিয়ে বন্ধ দোরে ঠেলা দিল। দোর খুলে গেল; খোলা দোর দিয়ে দেখা গেল‌, বেণীমাধব খাটের ওপর শুয়ে আছেন‌, তাঁর গলায় নীচে গাঢ় রক্তের চাপ জমা হয়ে আছে। মেঘরাজকে যেভাবে যে-অস্ত্র দিয়ে গলা কাটা হয়েছে বেণীমাধবকে ঠিক সেইভাবে সেই অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

কান্নার একটা কলরোল উঠল। নিখিল ক্ষণিকের জন্য জড়বৎ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের মধ্যে ছুটে গিয়ে টেলিফোন তুলে নিল। প্রথমে নিজের সংবাদপত্রের অপিসে ফোন করল‌, তারপর থানায়।

ব্যোমকেশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখল‌, সদর দরজায় পুলিস পাহারা। কনস্টেবল ব্যোমকেশকে দেখে স্যালুট করল‌, বলল–’ইন্সপেক্টর সাহেব নীচের তলায় বসবার ঘরে আছেন।’

প্রশস্ত ড্রয়িং রুমে ইন্সপেক্টর রাখাল সরকার এবং দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর উপস্থিত ছিলেন; মধ্য টেবিল ঘিরে একটা ফাইল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ব্যোমকেশ প্রবেশ করতেই রাখালবাবু তার কাছে এসে দাঁড়ালেন‌, করুণ হেসে বললেন—’জড়িয়ে পড়েছি ব্যোমকেশদা। বেণীসংহার নামটা আপনি ঠিকই দিয়েছেন। বেণীসংহার শব্দের আসল মানে শুনেছি খোঁপা বাঁধা; মেয়েরা প্রথমে চুলের বিনুনি করে‌, তারপর বিনুনি জড়িয়ে খোঁপা বাঁধে। এ ব্যাপারও অনেকটা সেই রকম; এমন জটিল কুটিল তার বাঁধুনি যে বেণীসংহার উন্মোচন করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুনের মোটিভ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে‌, সন্দেহভাজন লোকের সংখ্যাও পাঁচজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ; তবু ঠিক কোন লোকটি এ কাজ করেছে তা ধরা যাচ্ছে না।’

‘এসো‌, বসা যাক।।’ দু’জনে দুটো চেয়ারে ঘেঁষাৰ্ঘেষি হয়ে বসলেন-‘এবার বলে।’

রাখালবাবু কাল থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তা ব্যোমকেশকে শোনালেন‌, প্রশ্নোত্তরের ভিতর দিয়েও কয়েকটি তথ্য প্রকাশ পেল। ব্যোমকেশ বলল–’মোটিভ কি?’

0 Shares