অভিমান ও জিদের বিরুদ্ধে তর্ক করা বৃথা। রাত্রি হইয়াছিল। আমরা উঠিলাম। পরদিন প্ৰাতে আবার আসিবার আশ্বাস দিয়া নীচে নামিয়া গেলাম।
পথে কোনো কথা হইল না। বরদাবাবু দু-একবার কথা বলিবার উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু ব্যোমকেশ তাহা শুনিতে পাইল না। বরদাবাবু আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া গেলেন।
দুইতিমধ্যে বাড়ি ফিরিয়াছিলেন, আমরা বসিবার ঘরে প্রবেশ করতেই বললেন, কি হে, কি হ’ল?’
ব্যোমকেশ একটা আরাম-কেদারায় শুইয়া পড়িয়া উৰ্ধৰ্বমুখে বলিল, ‘প্রেতের আবির্ভাব হল।’ তাহার পর দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া কতকটা যেন আত্মগতভাবেই বলিল, ‘কিন্তু বরদাবাবুর প্রেত এবং কৈলাসবাবুর পিশাচ মিলে ব্যাপারটা ক্রমেই বুড় জটিল করে তুলেছে।’
পরদিন রবিবার ছিল। প্ৰাতঃকালে উঠিয়া ব্যোমকেশ শশাঙ্কবাবুকে বলিল, ‘চল, কৈলাসবাবুর বাড়িটা ঘুরে আসা যাক।’
শশাঙ্কবাবু বলিলেন, ‘আবার ভূত দেখতে চাও নাকি? কিন্তু দিনের বেলা গিয়ে লাভ কি? রাত্রি ছাড়া তো অশরীরীর দর্শন পাওয়া যায় না।’
‘কিন্তু যা অশরীরী নয়–অৰ্থাৎ বস্তু—তার তো দর্শন পাওয়া যেতে পারে।’
‘বেশ, চল।’
সাতটা বাজিতে না বাজিতে উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছিলাম। কৈলাসবাবুর বাড়ি তখনো সম্পূর্ণ জাগে নাই। একটা চাকর নিদ্ৰালুভাবে নীচের বারান্দা ঝাঁট দিতেছে; উপরে গৃহস্বামীর কক্ষে দরজা জানালা বন্ধ। ব্যোমকেশ বলিল, ক্ষতি নেই। বাগানটা ততক্ষণ ঘুরে ফিরে দেখি এস।’
শিশির ভেজা ঘাসে সমস্ত বাগানটি আন্তীর্ণ। সোনালী রৌদ্রে দেওদারের চুনট-করা পাতা জরির মত ঝলমল করিতেছে। চারিদিকে শারদ প্রাতের অপূর্ব পরিচ্ছন্নতা। আমরা ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।
বাগানটি পরিসরে বিঘা চারেকের কম হইবে না। কিন্তু ফুলবাগান বলিয়া কিছু নাই। এখানে সেখানে গোটা-কতক দোপাটি ও করবীর ঝাড় নিতান্ত অনাদৃতভাবে ফুল ফুটাইয়া রহিয়াছে। মালী নাই, বোধকরি বৈকুণ্ঠবাবুর আমলেও ছিল না। আগাছার জঙ্গল বৃদ্ধি পাইলে সম্ভবত বাড়ির চাকরেরাই কাটিয়া ফেলিয়া দেয়।
তাহার পরিচয় বাগানের পশ্চিমদিকে এক প্ৰান্তে পাইলাম। দেয়ালের কোণ ঘোষিয়া আবর্জনা জমা হইয়া আছে। উনানের ছাঁই, কাঠ-কুটা, ছেড়া কাগজ, বাড়ির জঞ্জাল-সমস্তই এইখানে ফেলা হয়। বহুকালের সঞ্চিত জঞ্জাল রৌদ্রে বৃষ্টিতে জমাট বাঁধিয়া স্থানটাকে স্বকীত করিয়া তুলিয়াছে।
এই আবর্জনার গাদার উপর উঠিয়া ব্যোমকেশ অনুসন্ধিৎসুভাবে এদিক-ওদিক তাকাইতে লাগিল। জুতা দিয়া ছাই-মাটি সরাইয়া দেখিতে লাগিল। একবার একটা পুরানো টিনের কোটা তুলিয়া লইয়া ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া আবার ফেলিয়া দিল। শশাঙ্কবাবু তাহার রকম দেখিয়া বলিলেন, ‘কি হে, ছাইগাদার মধ্যে কি খুঁজছ?’
ব্যোমকেশ ছাইগাদা হইতে চোখ না তুলিয়াই বলিল, ‘আমাদের প্রাচীন কবি বলেছেন-যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ। তাই, পাইলে পাইতে পার-এটা কি?’
একটা চিড়্ধরা পরিত্যক্ত লণ্ঠনের চিমনি পড়িয়াছিল; সেটা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ তাহার খোলের ভিতর দেখিতে লাগিল। তারপর সম্ভার্পণে তাহার ভিতর আঙুল ঢুকাইয়া একখণ্ড জীর্ণ কাগজ বাহির করিয়া আনিল। সম্ভবত বায়ুতাড়িত হইয়া কাগজের টুকরাটা চিমনির মধ্যে আশ্রয় লইয়াছিল; তারপর দীর্ঘকাল সেইখানে রহিয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ চিমনি ফেলিয়া দিয়া কাগজখানা নিবিষ্টচিত্তে দেখিতে লাগিল। আমিও উৎসুক হইয়া তাহার পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম।
কাগজখানা একটা ছাপা ইস্তহারের অর্ধাংশ; তাহাতে কয়েকটা অস্পষ্ট জন্তু জানোয়ারের ছবি রহিয়াছে মনে হইল। জল-বৃষ্টিতে কাগজের রং ব্বিৰ্ণ হইয়া গিয়াছে, ছাপার কালিও এমন অস্পষ্ট হইয়া পড়িয়াছে যে পাঠোদ্ধার দুঃসাধ্য।
শশাঙ্কবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি দেখছি হে? ওতে কি আছে?’
‘কিছু না।’ ব্যোমকেশ কাগজখানা উল্টাইয়া তারপর চোখের কাছে আনিয়া ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল, হাতের লেখা রয়েছে। দ্যাখ তো পড়তে পার কিনা।’ বলিয়া কাগজ আমার হাতে দিল।
অনেকক্ষণ ধরিয়া পরীক্ষা করিলাম। হাতের লেখা যে আছে তাহা প্রথমটা ধরাই যায় না। কালির চিহ্ন বিন্দুমাত্র নাই, কেবল মাঝে মাঝে কলমের আঁচড়ের দাগ দেখিয়া দুএকটা শব্দ অনুমান করা যায়—
বিপদে…… হাতে টাক…
বাবা….. নচেৎ ….. মরীয়া
…তোমার স্বাথী…
ব্যোমকেশকে আমার পাঠ জানাইলাম। সে বলিল, ‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। কাগজটা থাক।’ বলিয়া ভাঁজ করিয়া পকেটে রাখিল।
আমি বলিলাম, ‘লেখক বোধ হয় খুব শিক্ষিত নয়–বানান ভুল করেছে। ‘স্বাথী’ লিখেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শব্দটা ‘স্বাধী নাও হতে পারে।’
শশাঙ্কবাবু ঈষৎ অধীরকণ্ঠে বলিলেন, “চল চল, আস্তাকুড় ঘেঁটে লাভ নেই। এতক্ষণে বোধহয় কৈলাসবাবু উঠেছেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, ঐ যে তাঁর ভৌতিক জানালা খোলা দেখছি। চল।’
৫
বাড়ির নিকটস্থ হইয়া দেখিলাম, জানোলা দিয়া কৈলাসবাবু মুখ বাড়াইয়া আছেন। শীর্ণ ফ্যাকাসে মুখ-প্ৰাতঃকাল না হইয়া রাত্ৰি হইলে তাঁহাকে সহসা ঐ জানালার সম্মুখে দেখিয়া প্রেত বলিয়া বিশ্বাস করিতে কাহারো সংশয় হইত না।
তিনি আমাদের উপরে আহ্বান করিলেন। ব্যোমকেশ একবার জানালার নীচের মাটির উপর ক্ষিপ্ৰদৃষ্টি বুলাইয়া লইল। সবুজ ঘাসের পুরু গালিচা বাড়ির দেয়াল পর্যন্ত গিয়া ঠেকিয়াছে; তাহার উপর কোনো প্রকার চিহ্ন নাই।