ব্যোমকেশ ও বরদা

উপরে কৈলাসবাবুর ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম ঘরে চায়ের সরঞ্জাম প্ৰস্তুত। চা যদিও আমাদের একদফা হইয়া গিয়াছিল‌, তবু দ্বিতীয়বার সেবন করিতে আপত্তি হইল না।

চায়ের সহিত নানাবিধ আলোচনা চলিতে লাগিল। স্থানীয় জল-হাওয়ার ক্রমিক অধঃপতন‌, ডাক্তারদের চিকিৎসা-প্ৰণালীর ক্রমিক ঊর্ধ্বগতি‌, টোটকা ঔষধের গুণ‌, মরণ-উচাটন‌, ভূতের রোজা ইত্যাদি কোনো প্রসঙ্গই বাদ পড়িল না। ব্যোমকেশ তাহার মাঝখানে একবার জিজ্ঞাসা করিল‌, রাত্রে আপনি জানালা বন্ধ করে শুচ্ছেন তো?’

কৈলাসবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ—তিনি দেখা দিতে আরম্ভ করা অবধি জানালা দরজা বন্ধ করেই শুতে হচ্ছে-যদিও সেটা ডাক্তারের বারণ। ডাক্তার চান আমি অপব্যাপ্ত বায়ু সেবন করি।-কিন্তু আমার যে হয়েছে উভয় সঙ্কট। কি করি বলুন?’

‘জানালা বন্ধ করে কোন ফল পেয়েছেন কি?’

‘বড় বেশি নয়। তবে দর্শনটা পাওয়া যায় না‌, এই পর্যন্ত। নিশুতি রাত্রে যখন তিনি আসেন‌, জানালায় সজোরে ঝাঁকানি দিয়ে যান-একলা শুতে পারি না; রাত্রে একজন চাকর ঘরের–মেঝেয় বিছানা পেতে শোয়।’

চা সমাপন্যান্তে ব্যোমকেশ উঠিয়া বলিল‌, ‘এইবার আমি ঘরটা ভাল করে দেখব! শশাঙ্ক‌, কিছু মনে কোরো না; তোমাদের-অৰ্থাৎ পুলিসের-কর্মদক্ষতা সম্বন্ধে আমি কটাক্ষা করছি না; কিন্তু মুনীনাঞ্চ মতিভ্ৰমঃ। যদি তোমাদের কিছু বাদ পড়ে থাকে। তাই আর একবার দেখে নিচ্ছি।’

শশাঙ্কবাবু একটা বাঁকা-সুরে বলিলেন‌, ‘তা বেশ-নাও। কিন্তু এতদিন পরে যদি বৈকুণ্ঠবাবুর হত্যাকারীর কোনো চিহ্ন বার করতে পার‌, তাহলে বুঝব তুমি যাদুকর।’

ব্যোমকেশ হাসিল‌, ‘তাই বুঝে। কিন্তু সে যাক। বৈকুণ্ঠবাবুর মৃত্যুর দিন এ ঘরে কোন আসবাবই ছিল না?’

‘বলেছি তো মাটিতে-পাতা বিছানা‌, জলের ঘাড়া আর পানের বাটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।–হ্যাঁ‌, একটা তামার কনখুস্কিও পাওয়া গিয়েছিল।’

‘বেশ। আপনারা তাহলে গল্প করুন কৈলাসবাবু্‌, আমি আপনাদের কোন বিঘ্ন করব না। কেবল ঘরময় ঘুরে বেড়াবা মাত্র।’

অতঃপর ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে পরিক্রমণ করিতে আরম্ভ করিল। কখনো উৰ্ধৰ্বমুখে ছাদের দিকে তাকাইয়া‌, কখনো হেঁট মুখে মেঝের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া চিন্তাক্লান্ত মুখে নিঃশব্দে ঘুরিতে লাগিল। একবার জানালার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কাঠ শার্সি প্রভৃতি ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল; দরজার হুড়কা ও ছিটাকিন লগাইয়া দাঁড়াইয়া দেখিল। তারপর আবার পরিক্রমণ শুরু করিল।

কৈলাস ও শশাঙ্কবাবু স-কৌতুহলে তাহার গতিবিধি পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। আমি তখন জোর করিয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিলাম। কারণ ব্যোমকেশের মন যতই বহিনিরপেক্ষ হোক‌, তিন জোড়া কুতুহলী চক্ষু অনুক্ষণ তাহার অনুসরণ করিতে থাকিলে সে যে বিক্ষিপ্তচিত্ত ও আত্মসচেতন হইয়া পড়িবে তাহাতে সন্দেহ নাই। তাই‌, যাহোক একটা কথা আরম্ভ করিয়া দিয়া ইহাদের দুইজনের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া লইবার চেষ্টা করিলাম। তবু্‌, নানা অসংলগ্ন চাচার মধ্যেও আমাদের মন ও চক্ষু তাহার দিকেই পড়িয়া রহিল।

পনেরো মিনিট এইভাবে কাটিল। তারপর শশাঙ্কবাবুর একটা পুলিস-ঘটিত কাহিনী শুনিতে শুনিতে অলক্ষিতে অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিলাম‌, ব্যোমকেশের দিকে নজর ছিল না; হঠাৎ ছোট্ট একটা হাসির শব্দে সচকিতে ঘাড় ফিরাইলাম। দেখিলাম‌, ব্যোমকেশ দক্ষিণ দিকের দেয়ালের খুব কাছে দাঁড়াইয়া দেয়ালের দিকে তাকাইয়া আছে ও মৃদু মৃদু হাসিতেছে।

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘কি হল আবার! হাসছ যে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যাদু। দেখে যাও। এটা নিশ্চয় তোমরা আগে দ্যাখনি।’ বলিয়া দেয়ালের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।

আমরা সাগ্রহে উঠিয়া গেলাম। প্রথমটা চুনকাম করা দেয়ালের গায়ে কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। তারপর ভাল করিয়া লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম‌, মেঝে হইতে আন্দাজ পাঁচ ফুট উচ্চে সাদা। চুনের উপর পরিষ্কার অঙ্গুষ্ঠের ছাপ অঙ্কিত রহিয়াছে। যেন কাঁচা চুনের উপর আঙুল টিপিয়া কেহ। চিহ্নটি রাখিয়া গিয়াছে।

শশাঙ্কবাবু ভ্রূকুটি সহকারে চিহ্নটি দেখিয়া বলিলেন‌, ‘একটা বুড়ো-আঙুলের ছাপ দেখছি। এর অর্থ কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অর্থ–মুনীনাঞ্চ মতিভ্ৰমঃ। হত্যাকারীর এই পরিচয় চিহ্নটি তোমরা দেখতে পাওনি।’

বিস্ময়ে ভু তুলিয়া শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘হত্যাকারীর! এ আঙুলের দাগ যে হত্যাকারীর তা তুমি কি করে বুঝলে? আমরা আগে ওটা লক্ষ্য করিনি বটে। কিন্তু তাই বলে ওটা হত্যাকারীর আঙুলের দাগ যে কেন হবে-তাও তো বুঝতে পারছি না। যে রাজমিস্ত্রি ঘর চুনকাম করেছিল তার হতে পারে; অন্য যে-কোনো লোকের হতে পারে।’

‘একেবারে অসম্ভব নয়। তবে কথা হচ্ছে‌, রাজমিস্ত্রি দেয়ালে নিজের আঙুলের টিপ রেখে যাবে কেন?’

‘তা যদি বল‌, হত্যাকারীই বা রেখে যাবে কেন?’

ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার শশাঙ্কবাবুর দিকে তাকাইল; তারপর বলিল‌, ‘তাও তো বটে। তাহলে তোমার মতে ওটা কিছুই নয়?’

‘আমি বলতে চাই‌, ওটা যে খুব জরুরী তার কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।’

ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তোমার যুক্তি অকাট্য। প্রমাণের অভাবে কোন জিনিসকেই জরুরী বলে স্বীকার করা যেতে পারে না। —পকেটে ছুরি আছে? কিম্বা কানখুস্কি?’

‘ছুরি আছে। কেন?’

অপ্ৰসন্ন মুখে শশাঙ্কবাবু ছুরি বাহির করিয়া দিলেন। ব্যোমকেশের আবিষ্কারে তিনি সুখী হইতে পারেন নাই‌, তাই বোধ হয় সেটাকে তুচ্ছ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। কিন্তু তবু তাঁহার মনোভাব নেহাৎ অযৌক্তিক বলিয়া বোধ হইল না। দেয়ালের গায়ে একটা আঙুলের চিহ্ন-কবে কাহার দ্বারা অঙ্কিত হইয়াছে কিছুই জানা নাই—হত্যাকাণ্ডের রহস্য-সমাধানে ইহার মূল্য কি? এবং যদি উহা হত্যাকারীরই হয় তাহা হইলেই বা লাভ কি হইবে? কে হত্যাকারী তোহই যখন জানা নাই তখন এই আঙুলের টিপ কোন কাজে লাগিবে তাহা আমিও বুঝিতে পারিলাম না।

0 Shares