ব্যোমকেশ ও বরদা

ব্যোমকেশ কিন্তু ছুরি দিয়া চিহ্নটির চারিধারে দাগ কাটিতে আরম্ভ করিল। অতি সন্তৰ্পণে চুন-বালি আলগা করিয়া ছুরির নখ দিয়া একটু চাড় দিতেই টিপ-চিহ্ন সমেত খানিকটা প্ল্যাস্টার বাহির হইয়া আসিল। ব্যোমকেশ সেটি সযত্নে রুমালে জড়াইয়া পকেটে রাখিয়া কৈলাসবাবুকে বলিল–’ ‘আপনার ঘরের দেয়াল কুশ্ৰী করে দিলাম। দয়া করে একটু চুন দিয়ে গর্তটা ভরাট করিয়ে নেবেন।’ তারপর শশাঙ্কবাবুকে বলিল‌, ‘চল শশাঙ্ক‌, এখানকার কোজ আপাতত আমাদের শেষ হয়েছে। এদিকে দেখছি নটা বাজে; কৈলাসবাবুকে আর কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। —ভাল কথা‌, কৈলাসবাবু্‌, আপনি বাড়ি থেকে নিয়মিত চিঠিপত্ৰ পান তো?’

কৈলাসবাবু বলিলেন‌, ‘আমাকে চিঠি দেবে কে? একমাত্র ছেলে-তার গুণের কথা তো শুনেছেন; চিঠি দেবার মত আত্মীয় আমার কেউ নেই।’

প্রফুল্লম্বরে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বড়ই দুঃখের বিষয়। আচ্ছা‌, আজ তাহলে চললুম; মাঝে মাঝে আপনাকে বিরক্ত করতে আসব। আর দেখুন‌, এটার কথা কাউকে বলে দরকার নেই।’ বলিয়া দেয়ালের ছিদ্রের দিকে নির্দেশ করিল।

কৈলাসবাবুঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইলেন। রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িলাম। রৌদ্র তখন কড়া হইতে আরম্ভ করিয়াছে। দ্রুতপদে বাসার দিকে চলিলাম।

হঠাৎ শশাঙ্কবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘ব্যোমকেশ‌, ওই আঙুলের দাগটা সম্বন্ধে তোমার সত্যিকার ধারণা কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার ধারণা তো বলেছি‌, ওটা হত্যাকারীর আঙুলের দাগ।’

অধীরভাবে শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘কিন্তু এ যে তোমার জবরদস্তি। হত্যাকারী কে তার নামগন্ধও জানা নেই।–অথচ তুমি বলে বসলে ওটা হত্যাকারীর। একটা সঙ্গত কারণ দেখান চাই তো।’

‘কি রকম সঙ্গত কারণ তুমি দেখতে চাও?’

শশাঙ্কবাবুর কণ্ঠের বিরক্তি আর চাপা রহিল না‌, তিনি বলিয়া উঠিলেন‌, ‘আমি কিছুই দেখতে চাই না। আমার মনে হয় তুমি নিছক ছেলেমানুষী করছ। অবশ্য তোমার দোষ নেই; তুমি ভাবিছ বাংলা দেশে যে প্রথায় অনুসন্ধান চলে এদেশেও বুঝি তাই চলবে। সেটা তোমার ভুল। ও ধরনের ডিটেকটিভগিরিতে এখানে কোন কাজ হবে না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভাই‌, আমার ডিটেকটিভ বিদ্যে কাজে লাগাবার জন্য তো আমি তোমার কাছে আসিনি‌, বরং ওটাকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্যই এসেছি। তুমি যদি মনে কর এ ব্যাপারে আমার হস্তক্ষেপ করবার দরকার নেই তাহলে তো আমি নিষ্কৃতি পেয়ে বেঁচে যাই।’

শশাঙ্কবাবু সামলাইয়া লইয়া বলিলেন‌, ‘না‌, আমি তা বলছি না। আমার বলার উদ্দেশ্য‌, ওপথে চললে কস্মিন কালেও কিছু করতে পারবে না–এ ব্যাপার অত সহজ নয়।’

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’

‘ছ’মাস ধরে আমরা যে-ব্যাপারের একটা হদিস বার করতে পারলুম না‌, তুমি একটা আঙুলের টিপ দেখেই যদি মনে কর তার সমাধান করে ফেলেছি‌, তাহলে বুঝতে হবে এ কেসের গুরুত্ব তুমি এখনো ঠিক ধরতে পােরনি। আঙুলের দাগ কিম্বা আস্তাকুড়ে কুড়িয়ে পাওয়া ছেড়া কাগজে দুটো হাতের অক্ষর-এসব দিয়ে লোমহর্ষণ উপন্যাস লেখা চলে‌, পুলিসের কাজ চলে না। তাই বলছি‌, ওসব আঙুলের টিপা-ফিপ ছেড়ে—’

‘থামো।’

পাশ দিয়া একখানা ফিটন গাড়ি যাইতেছিল‌, তাহার আরোহী আমাদের দেখিয়া গাড়ি থামাইলেন; গলা বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘কি ব্যোমকেশবাবু্‌, কদ্দুর?’

তারাশঙ্করবাবু গঙ্গাস্নান করিয়া বাড়ি ফিরিতেছেন; কপালে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ‌, গায়ে নামাবলী্‌্‌, মুখে একটা ব্যঙ্গ-হাস্য।

ব্যোমকেশ তাঁহার প্রশ্নে ভালমানুষের মত প্ৰতিপ্রশ্ন করিল—’কিসের?’

‘কিসের আবার—বৈকুণ্ঠের খুনের। কিছু পেলেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এ বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করছেন কেন? আমার তো কিছু জানিবার কথা নয়। বরং শশাঙ্ককে জিজ্ঞাসা করুন।’

তারাশঙ্করবাবু বাম ভ্রু ঈষৎ তুলিয়া বলিলেন‌, ‘কিন্তু শুনেছিলুম যেন‌, আপনিই নূতন করে এ কেসের তদন্ত করবার ভার পেয়েছেন! তা সে যা হোক‌, শশাঙ্কবাবু্‌, খবর কি? নূতন কিছু আবিষ্কার হল?’

শশাঙ্কবাবু নীরসকণ্ঠে বলিলেন‌, ‘আবিষ্কার হলেও পুলিসের গোপন কথা সাধারণে প্রকাশ করবার আমার অধিকার নেই। আর‌, ওটা আপনি ভুল শুনেছেন।–ব্যোমকেশ আমার বন্ধু‌, মুঙ্গেরে বেড়াতে এসেছে‌, তদন্তের সঙ্গে তার কোন সংস্রব নেই।’

পুলিসের সহিত উকিলের প্রণয় এ জগতে বড়ই দুর্লভ। দেখিলাম‌, তারাশঙ্করবাবু ও শশাঙ্কবাবুর মধ্যে ভালবাসা নাই। তারাশঙ্করবাবু কণ্ঠস্বরে অনেকখানি মধু ঢালিয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘বেশ বেশ। তাহলে কিছুই পারেননি। আপনাদের দ্বারা যে এর বেশি হবে না তা আগেই আন্দাজ করেছিলুম।–হাঁকো।’

তারাশঙ্করবাবুর ফিটন বাহির হইয়া গেল।

শশাঙ্কবাবু কটমটে চক্ষে সেইদিকে তাকাইয়া অস্ফুটস্বরে যাহা বলিলেন তাহা প্রিয়সম্ভাষণ নয়। ভিতরে ভিতরে সকলেরই মেজাজ রুক্ষ হইয়া উঠিয়াছিল। পথে আর কোন কথা হইল না‌, নীরবে তিনজনে বাসায় গিয়া পৌঁছিলাম।

দুপুরবেলাটা ব্যোমকেশ অলসভাবে কাটাইয়া দিল। একবার ছেড়া কাগজখানা ও আঙুলের টিপ বাহির করিয়া অবহেলাভরে দেখিল; আবার সরাইয়া রাখিয়া দিল। তাহার মনের ক্রিয়া ঠিক বুঝিলাম না; কিন্তু বোধ হইল‌, এই হত্যার ব্যাপারে। এতাবৎকাল সে যেটুকু আকর্ষণ অনুভব করিতেছিল তাহাও যেন নিবিয়া গিয়াছে।

অপরাহ্নে বরদাবাবু আসিলেন। বলিলেন‌, ‘এখানে আমাদের বাঙালীদের একটা ক্লাব আছে‌, চলুন আজ। আপনাদের সেখানে নিয়ে যাই।’

‘চলুন।’

0 Shares