ব্যোমকেশ ও বরদা

দুইদিন এখানে আসিয়াছি কিন্তু এখনো স্থানীয় দ্রষ্টব্য বস্তু কিছুই দেখি নাই; তাই বরদাবাবু আমাদের কষ্টহারিণীর ঘাট‌, পীর-শানফার কবর ইত্যাদি কয়েকটা স্থান ঘুরাইয়া দেখাইলেন। তারপর সূৰ্য্যস্ত হইলে তাঁহাদের ক্লারে লইয়া চলিলেন।

কেল্লার বাহিরে ক্লাব। পথে যাইতে দেখিলাম-একটা মাঠের মাঝখানে প্রকাণ্ড তাঁবু। পড়িয়াছে; তাহার চারিদিকে মানুষের ভিড়-তাঁবুর ভিতর হইতে উজ্জ্বল আলো এবং ইংরাজি বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ আসিতেছে।

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘ওটা কি?’

‘একটা সার্কাস পাটি এসেছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখানে সার্কাস পাটিও আসে নাকি?’

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘আসে বৈকি। বিলক্ষণ দু’পয়সা রোজগার করে নিয়ে যায়। এই তো গত বছর একদল এসেছিল–না‌, গত বছর নয়‌, তার আগের বছর।’

‘এরা কতদিন হল এসেছে?’

‘কাল শনিবার ছিল‌, কাল থেকে এরা খেলা দেখাতে শুরু করেছে।’

প্রসঙ্গত শহরের আমোদ-প্রমোদের অভাব সম্বন্ধে বরদাবাবু অভিযোগ করিলেন। মুষ্টিমেয় বাঙালীর মধ্যে চিরন্তন দলাদলি‌, তাই থিয়েটারের একটা সখের দল থাকা সত্ত্বেও অভিনয় বড় একটা ঘটিয়া ওঠে না; বাহির হইতে এক-আধটা কাৰ্ণিভালের দল যাহা আসে তাঁহাই ভরসা। শুনিয়া খুব বেশি বিস্মিত হইলাম না। বাঙালীর বাস্তব জীবনে যে জাঁকজমক ও বৈচিত্র্যের অসদ্ভাব‌, তাহা সে থিয়েটারের রাজা বা সেনাপতি সাজিয়া মিটাইয়া লইতে চায়। তাই যেখানে দুইজন বাঙালী আছে সেইখানেই থিয়েটার ক্লাব থাকিতে বাধ্য এবং যেখানে থিয়েটার ক্লাব আছে সেখানে দলাদলি অবশ্যম্ভাবী। আমোদ-প্ৰমোদের জন্য চালানি মালের উপর নির্ভর করিতে হইবে ইহার আর বিচিত্র কি?

শুনিতে শুনিতে ক্লাবে আসিয়া পৌঁছিলাম।

ক্লাবের প্রবেশপথটি সঙ্কীর্ণ হইলেও ভিতরে বেশ সুপ্রসর। খানিকটা খোলা জায়গার উপর কয়েকখানি ঘর। আমরা প্ৰবেশ করিয়া দেখিলাম‌, একটি ঘরে ফরাস পাতা‌, তাহার উপর বসিয়া কয়েকজন সভ্য ব্রিজ খেলিতেছেন; প্ৰতি হাত খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারা সমালোচনায় মুখর হইয়া উঠিতেছেন‌, আবার খেলা আরম্ভ হইবামাত্ৰ সকলে গভীর ও স্বল্পবাক হইয়া পড়িতেছেন। ক্রীড়াচক্রের বাহিরে তাঁহাদের চিত্ত কোন অবস্থাতেই সঞ্চারিত হইতেছে না; আমরা দুইজন আগন্তুক আসিলাম তাহা কেহ লক্ষ্যই করিলেন না। ঘরের এক কোণে দুইটি সভ্য দাবার ছক লইয়া তুরীয় সমাধির অবস্থায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন‌, সুতরাং বাজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁহাদের কঠোর তপস্যা অন্সরার ঝাঁক আসিয়াও ভাঙিতে পরিবে না।

পাশের ঘর হইতে কয়েকজন উত্তেজিত সভ্যোর গলার আওয়াজ আসিতেছিল‌, বরদাবাবু আমাদের সেই ঘরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম‌, একটি টেবিল বেষ্টন করিয়া কয়েকজন যুবক বসিয়া আছেন—তন্মধ্যে আমাদের পূর্বপরিচিত শৈলেনবাবুও বর্তমান। তাঁহাকে বাকি সকলে সপ্তরিখীর মত ঘিরিয়া ফেলিয়াছেন এবং ভূতযোনি সম্বন্ধে নানাবিধ সুতীক্ষা ও সন্দেহমূলক বাক্যজালে বিদ্ধ করিয়া প্ৰায় ধরাশায়ী করিবার উপক্ৰম করিয়াছেন।

বরদাবাবুকে দেখিয়া শৈলেনবাবুর চোখে পরিত্রাণের আশা ফুটিয়া উঠিল‌, তিনি হাত বাড়াইয়া বলিলেন‌, ‘আসুন বরদাবাবু্‌, এঁরা আমাকে একেবারে-; এই যে‌, ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনারাও এসেছেন। আসতে আজ্ঞা হোক।’

নবাগত দুইজনকে দেখিয়া তর্ক বন্ধ হইল। বরদাবাবু আমাদের পরিচয় দিয়া‌, আমরা উপবিষ্ট হইলে জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘তোমরা এত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলে কেন? কি হয়েছে?’

শৈলেনবাবু বলিলেন‌, ‘ওঁরা আমার ভূত দেখার কথা বিশ্বাস করছেন না‌, বলছেন ওটা আমারই মস্তিষ্কপ্রসূত একটা বায়বীয় মূর্তি।’

পৃথ্বীশবাবু নামক একটি ভদ্রলোক বলিলেন‌, ‘আমরা বলতে চাই‌, বরদার আষাঢ়ে গল্প শুনে শুনে ওঁর মনের অবস্থা এমন হয়েছে যে উনি ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখছেন। বস্তুত যেটাকে উনি ভূত মনে করছেন সেটা হয়তো একটা বাদুড় কিম্বা ঐ জাতীয় কিছু।’

শৈলেনবাবু বলিলেন‌, ‘আমি স্বীকার করছি যে আমি স্পষ্টভাবে কিছু দেখিনি। তবু বাদুড় যে নয় একথা আমি হলফ নিয়ে বলতে পারি। আর বরদাবাবুর গল্প শুনে আমি চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। এ অপবাদ যদি দেন–’

বরদাবাবু আমাদের দিকে নির্দেশ করিয়া গভীর স্বরে কহিলেন‌, ‘এঁরা দু’জন কাল সকালে এখানে এসেছেন। এঁদেরও আমি গল্প শুনিয়ে বশীভূত করে ফেলেছি বলে সন্দেহ হয় কি?’

একজন প্ৰতিদ্বন্দ্বী বলিলেন‌, ‘না‌, তা হয় না। তবে সময় পেলে–’

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘ওঁরা কাল রাত্রে দেখেছেন।’ সকলে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া গেলেন। তারপর পৃথীশবাবু ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘সত্যি দেখেছেন?’

ব্যোমকেশ স্বীকার করিল‌, ‘হ্যাঁ।’

‘কি দেখেছেন?’

‘একটা মুখ।’

প্রতিদ্বন্দ্বীপক্ষ পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিতে লাগিলেন। তখন ব্যোমকেশ যে অবস্থায় ঐ মুখ দেখিয়াছিল তাহা বৰ্ণনা করিয়া বলিল। শুনিয়া সকলে নীরব হইয়া রহিলেন। বরদাবাবু ও শৈলেনবাবুর মুখে বিজয়ীর গর্বোল্লাস ফুটিয়া উঠিল।

অমূল্যবাবু এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন‌, তর্কে যোগ দেন নাই। তাঁহার মুখমণ্ডলে অনিচ্ছপীড়িত প্রত্যয় এবং অবরুদ্ধ অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব চলিতেছিল। যাহা বিশ্বাস করিতে চাহি না‌, তাহাই অনন্যেপায় হইয়া বিশ্বাস করিতে হইলে মানুষের মনের অবস্থা যেরূপ হয় তাঁহার মনের অবস্থাও সেইরূপ-কোন প্রকারে এই অনীন্সিত বিশ্বাসের মূল ছেদন করিতে পারিলে তিনি বাঁচেন। এইবার তিনি কথা কহিলেন‌, বিরুদ্ধতার শ্লেষ কণ্ঠ হইতে যথাসম্ভব অপসারিত করিয়া বলিলেন‌, ‘তা যেন হল‌, অনেকেই যখন দেখেছেন বলছেন।–তখন না হয়। ঘটনাটা সত্যি বলেই মেনে নেয়া গেল। কিন্তু কেন? বৈকুণ্ঠ জহুরী যদি ভুতই হয়ে থাকে তাহলে কৈলাসবাবুকে বিরক্ত করে তার কি লাভ হচ্ছে? এই কথাটা আমায় কেউ বুঝিয়ে দিতে পার?’

0 Shares