ব্যোমকেশ ও বরদা

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘প্রেতযোনির উদ্দেশ্য সব সময় বোঝা যায় না। তবে আমার মনে হয় বৈকুণ্ঠবাবু কিছু বলতে চান।’

অমূল্যবাবু বিরক্তভাবে বলিলেন‌, ‘বলতে চান তো বলছেন না কেন?’

‘সুযোগ পাচ্ছেন না। তাঁকে দেখেই আমরা এত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছি যে তাঁকে চলে যেতে হচ্ছে। তাছাড়া‌, প্ৰেতাত্মার মূর্তি পরিগ্রহ করবার ক্ষমতা থাকলেও কথা কইবার ক্ষমতা সর্বত্র থাকে না। একটাপ্লাজম নামক যে-বস্তুটা মূর্তি-গ্রহণের উপাদান–’

‘পণ্ডিত্য ফলিও না বরদা। Spiritualism-এর বইগুলো যে ঝাড়া মুখস্থ করে রেখেছি তা আমরা জানি। কিন্তু তোমার বৈকুণ্ঠবাবু যদি কথাই না বলতে পারবেন তবে নিরীহ একটি ভদ্রলোককে নাহিক জ্বালাতন করছেন কেন?’

‘মুখে কথা বলতে না পারলেও তাঁকে কথা বলাবার উপায় আছে।’

‘কি উপায়?’

‘টেবিল চালা।’

‘ও-সেই তেপায়া টেবিল? সে তো জুচ্চুরি।’

‘কি করে জানলে? কখনো পরীক্ষা করে দেখেছ?’

অমূল্যবাবুকে নীরব হইতে হইল। তখন বরদাবাবু আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন‌, ‘দেখুন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস বৈকুণ্ঠবাবুর কিছু বক্তব্য আছে; হয়তো তিনি হত্যাকারীর নাম বলতে চান। আমাদের উচিত। তাঁকে সাহায্য করা। টেবিল চেলে তাঁকে ডাকলে তিনি তাঁর বক্তব্য প্ৰকাশ করতে পারেন। টেবিল চালিয়ে দেখবেন?’

ভূত নামানো কখনও দেখি নাই; ভারি আগ্ৰহ হইল। বলিলাম‌, ‘বেশ তো‌, করুন না। এখনি করবেন?’

বরদবাবু বলিলেন‌, ‘দোষ কি? এইখানেই করা যাক-কি বল তোমরা? ভূত যদি নামে‌, তোমাদের সকলেরই সন্দেহ ভঞ্জন হবে।’

সকলেই সোৎসাহে রাজী হইলেন।

একটি ছোট টিপাই তৎক্ষণাৎ আনানো হইল। বরদাবাবু বলিলেন যে‌, বেশি লোক থাকিলে চক্র হইবে না‌, তাই পাঁচজনকে বাছিয়া লওয়া হইল। বরদাবাবু্‌, ব্যোমকেশ‌, শৈলেনবাবু্‌, অমূল্যবাবুও আমি রহিলাম। বাকি সকলে পাশের ঘরে গিয়া বসিলেন।

আলো কমাইয়া দিয়া আমরা পাঁচজন টিপাইয়ের চারিদিকে চেয়ার টানিয়া বসিলাম। কি করিতে হইবে বরদাবাবু সংক্ষেপে বুঝাইয়া দিলেন। তখন টিপাইয়ের উপর আলগোছে হাত রাখিয়া পরস্পর আঙুলে আঙুল ঠেকাইয়া মুদিত চক্ষে বৈকুণ্ঠবাবুর ধ্যান শুরু করিয়া দিলাম। ঘরের মধ্যে আবছায়া অন্ধকার ও অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করিতে লাগিল।

পাঁচ মিনিট এইভাবে কাটিল। ভূতের দেখা নাই। মনে আবোল-তাবোল চিন্তা আসিতে লাগিল; জোর করিয়া মনকে বৈকুণ্ঠবাবুর ধ্যানে জুড়িয়া দিতে লাগিলাম। এইরূপ টানাটানিতে বেশ অধীর হইয়া উঠিয়াছি‌, এমন সময় মনে হইল টিপাইটা যেন একটু নড়িল। হঠাৎ দেহে কাঁটা দিয়া উঠিল। স্থির হইয়া বসিয়া রহিলাম‌, আঙুলের স্নায়ুগুলা নিরতিশয় সচেতন হইয়া রহিল।

আবার টিপাই একটু নড়িল‌, যেন ধীরে ধীরে আমার হাতের নীচে ঘুরিয়া যাইতেছে।

বরদবাবুর গভীর স্বর শুনিলাম-“বৈকুণ্ঠবাবু এসেছেন কি? যদি এসে থাকেন একবার টোকা দিন।’

কিছুক্ষণ কোন সাড়া নাই। তারপর টিপাইয়ের একটা পায়া ধীরে ধীরে শূন্যে উঠিয়া ঠিক করিয়া মাটিতে পড়িল।

বরদাবাবু গভীর অথচ অনুচ্চ স্বরে কহিলেন‌, ‘আবির্ভাব হয়েছে!’

স্নায়ুর উত্তেজনা আরো বাড়িয়া গেল; কান ঝাঁ ঝাঁ করিতে লাগিল। চক্ষু মেলিয়া কিন্তু একটা বিস্ময়ের ধাক্কা অনুভব করিলাম। কি দেখিব আশা করিয়াছিলাম জানি না‌, কিন্তু দেখিলাম যেমন পাঁচজন আধা অন্ধকারে বসিয়াছিলাম। তেমনি বসিয়া আছি‌, কোথাও কোন পরিবর্তন হয় নাই। ইতিমধ্যে যে একটা গুরুতর রকম অবস্থান্তর ঘটিয়াছে’–এই ঘরে আমাদেরই আশেপাশে কোথাও অশরীরী আত্মা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে-তোহা বুঝিবার উপায় নাই।

বরদাবাবু নিম্নস্বরে আমাদের বলিলেন‌, ‘আমিই প্রশ্ন করি।–কি বলেন?’

আমরা শিরঃসঞ্চালনে সম্মতি জানাইলাম। তখন তিনি ধীর গভীরকণ্ঠে প্রেতিযোনিকে প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিলেন—

‘আপনি কি চান?’

কোনো উত্তর নাই। টিপাই অচল হইয়া রহিল।

‘আপনি বারবার দেখা দিচ্ছেন কেন?’

মনে হইল টিপাই একটু নড়িল। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও স্পষ্ট কিছু বুঝিতে পারা গেল না।

‘আপনার কিছু বক্তব্য আছে?’

এবার টিপাইয়ের পায়া স্পষ্টত উঠিতে লাগিল। কয়েকবার ঠক ঠক শব্দ হইল-অর্থ কিছু বোধগম্য হইল না।

বরদাবাবু কহিলেন‌, ‘যদি হ্যাঁ বলতে চান একবার টোকা দিন‌, যদি না বলতে চান দু’বার টোকা দিন।’

একবার টোকা পড়িল।

দেখিলাম‌, পরলোকের সহিত ভাব বিনিময়ের প্রণালী খুব সরল নয়। ‘হ্যাঁ‌, বা ‘না কোনোক্রমে বোঝানো যায়; কিন্তু বিস্তারিতভাবে মনের কথা প্ৰকাশ করা আশীরীরীর পক্ষে বড় কঠিন। কিন্তু তবু মানুষের বুদ্ধি দ্বারা সে বাধাও কিয়ৎপরিমাণে উল্লঙ্ঘিত হইয়াছে—সংখ্যার দ্বারা অক্ষর বুঝাইবার রীতি আছে। বরদাবাবু সেই রীতি অবলম্বন করিলেন; প্রেতিযোনিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন‌, ‘আপনি যা বলতে চান‌, অক্ষর গুণে গুণে টোকা দিন‌, তাহলে আমরা বুঝতে পারব।’

তখন টেলিগ্রাফে কথা আরম্ভ হইল। টিপাইয়ের পায়া ঠিক করিয়া কয়েকবার নড়ে্‌্‌, আবার স্তব্ধ হয়; আবার নড়ে-আবার স্তব্ধ হয়। এইভাবে দীর্ঘকাল ধরিয়া যে কথাগুলি অতি কষ্ট্রে বাহির হইয়া আসিল তাহা এই—

বাড়ি—ছেড়ে—যাও—নচেৎ–অমঙ্গল–

টিপাইয়ের শেষ শব্দ থামিয়া যাইবার পর আমরা কিছুক্ষণ ভয়স্তম্ভিতবৎ বসিয়া রহিলাম। তারপর বরদাবাবু গলাটা একবার ঝাড়িয়া লইয়া বলিলেন‌, ‘আপনার বাড়ি যাতে ছেড়ে দেওয়া হয় আমরা তার চেষ্টা করব। আর কিছু বলতে চান কি?’

0 Shares