ব্যোমকেশ ও বরদা

টিপাই স্থির।

আমার হঠাৎ একটা কথা মনে হইল‌, বরদাবাবুকে চুপি চুপি বলিলাম‌, হত্যাকারী কে জিজ্ঞাসা করুন।’

বরদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন। খানিকক্ষণ কোন উত্তর আসিল না; তারপর পায়া উঠিতে আরম্ভ করিল।

তা—রা—তা—রা—তা—রা—

হঠাৎ টিপাই কয়েকবার সজোরে নড়িয়া উঠিয়া থামিয়া গেল। বরদাবাবু কম্পিতম্বরে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘কি বললেন‌, বুঝতে পারলুম না। ‘তারা–কি? কারুর নাম?’

টিপাইয়ে সাড়া নাই।

আবার প্রশ্ন করিলেন‌, ‘আপনি কি আছেন?’

কোনো উত্তর আসিল না‌, টিপাই জড় বস্তুতে পরিণত হইয়াছে।

তখন বরদাবাবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন‌, ‘চলে গেছেন।’

ব্যোমকেশ হাত বাড়াইয়া আলোটা উজ্জ্বল করিয়া দিল; তারপর সকলের হাতের দিকে তীক্ষা দৃষ্টিতে তাকাইয়া নেহাৎ অরসিকের মত বলিল‌, ‘মাফ করবেন‌, এখন কেউ টিপাই থেকে হাত তুলবেন না। আপনাদের হাত আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’

বরদাবাবু ঈষৎ হাসিলেন—’আমরা কেউ হাতে আঠা লাগিয়ে রেখেছি। কিনা দেখতে চান? বেশ-দেখুন।’

ব্যোমকেশের ব্যবহারে আমি বড় লজ্জিত হইয়া পড়িলাম। এমন খোলাখুলিভাবে এতগুলি ভদ্রলোককে প্রবঞ্চক মনে করা নিতান্তই শিষ্টতা-বিগৰ্হিত। তাহার মনে একটা প্রবল সংশয় জাগিয়াছে সত্য-কিন্তু তাই বলিয়া এমন কঠোরভাবে সত্য পরীক্ষা করিবার তাহার কোন অধিকার নাই। সকলেই হয়তো মনে মনে ক্ষুন্ন হইলেন; কিন্তু ব্যোমকেশ নির্লজ্জভাবে প্ৰত্যেকের হাত পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়া দিল। এমন কি আমাকেও বাদ দিল না।

কিন্তু কাহারো হাতেই কিছু পাওয়া গেল না। ব্যোমকেশ তখন দুই করতলে গণ্ড রাখিয়া টিপাইয়ের উপর কনুই স্থাপনপূর্বক শূন্যদৃষ্টিতে আলোর দিকে তাকাইয়া রহিল।

বরদবাবু খোঁচা দিয়া বলিলেন‌, ‘কিছু পেলেন না?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আশ্চর্য! এ যেন কল্পনা করাও যায় না।’

বরদাবাবু প্রসন্নস্বরে বলিলেন ‘There are more things–’

অমূল্যবাবুর বিরুদ্ধতা একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল‌, তিনি অসংযতকষ্ঠে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘কিন্তু–’তারা ‘তারা কথার মানে কেউ বুঝতে পারলে?’

সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিলেন। আমার মাথায় হঠাৎ বিদ্যুতের মত খেলিয়া গেল-তারাশঙ্কর। আমি ঐ নামটাই উচ্চারণ করিতে যাইতেছিলাম‌, ব্যোমকেশ আমার মুখে থাবা দিয়া বলিল‌, ‘ও আলোচনা না হওয়াই ভাল।’

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ‌, আমরা যা জানতে পেরেছি তা আমাদের মনেই থাক।।* সকলে তাঁহার কথায় গভীর উদ্বিগ্নমুখে সায় দিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজকের অভিজ্ঞতা বড় অদ্ভুত—এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু না করেও উপায় নেই। বরদাবাবু্‌, এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’ বলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

বাড়ি ফিরিবার পথে বরদাবাবুর সহিত শৈলেনবাবু এবং অমূল্যবাবু আমাদের সাখী হইলেন। তাঁহাদের বাসা কেল্লার মধ্যে।

আমাদের বাসা নিকটবর্তী হইলে শৈলেনবাবু বলিলেন‌, ‘একলা বাসায় থাকি‌, আজ রাত্রে দেখছি ভাল ঘুম হবে না।’

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘আপনার আর ভয় কি? ভয় কৈলাসবাবুর।–আচ্ছা‌, ওঁকে বাড়ি ছাড়াবার কি করা যায় বলুন তো?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওঁকে ও-বাড়ি ছাড়াতেই হবে। আপনারা তো চেষ্টা করছেনই‌, আমিও করব। কৈলাসবাবু অবুঝ লোক‌, তবু ওঁর ভালর জন্যই আমাদের করতে হবে।–কিন্তু বাড়ি পৌঁছে যাওয়া গেছে‌, আর আপনারা কষ্ট করবেন না! নমস্কার।’

তিনজনে শুভনিশি জ্ঞাপন করিয়া ফিরিয়া চলিলেন। অমূল্যবাবুর কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম–শৈলেনবাবু্‌, আপনি বরং আজকের রাতটা আমার বাসাতেই থাকবেন চলুন। আপনিও একলা থাকেন‌, আমার বাসাতেও উপস্থিত আমি ছাড়া আর কেউ নেই–’

বুঝিলাম টেবিল চালার ব্যাপার সকলের মনের উপরেই আতঙ্কের ছায়া ফেলিয়াছে।

শশাঙ্কবাবু বোধহয় মনে মনে ব্যোমকেশ সম্বন্ধে হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন; তাই সেদিন কৈলাসবাবুর বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসার পর হইতে হত্যার প্রসঙ্গ আর ব্যোমকেশের সম্মুখে উত্থাপিত করেন নাই। তাছাড়া হঠাৎ তাঁহার অফিসে কাজের চাপ পড়িয়াছিল‌, পূজার ছুটির প্রাক্কালে অবকাশেরও অভাব ঘটিয়াছিল।

অতঃপর দুই তিনদিন আমরা শহরে ও শহরের বাহিরে যত্র তত্র পরিভ্রমণ করিয়া কাটাইয়া দিলাম। স্থানটি অতি প্রাচীন‌, জরাসন্ধের আমল হইতে ক্লাইভের সময় পর্যন্ত বহু কিম্বদন্তী ও ইতিবৃত্ত তাহাকে কেন্দ্ৰ করিয়া জমা হইয়াছে। পুরাবৃত্তের দিকে যাঁহাদের ঝোঁক আছে তাঁহাদের কাছে স্থানটি পরম লোভনীয়।

এই সব দেখিতে দেখিতে ব্যোমকেশ যেন হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলিয়াই গিয়াছিল। শুধু প্ৰত্যহ সন্ধ্যাকালে সে কৈলাসবাবুর বাসায় গিয়া জুটিত এবং নানাভাবে তাঁহাকে বাড়ি ছাড়িবার জন্য প্ররোচিত করিত। তাহার সুকৌশল বাক্য-বিন্যাসের ফলও ফলিয়ছিল‌, কৈলাসবাবু নিমরাজী হইয়া আসিয়াছিলেন।

শেষে সপ্তাহখানেক পরে তিনি সম্মত হইয়া গেলেন। কেল্লার বাহিরে একখানা ভাল বাড়ি পাওয়া গিয়াছিল‌, আগামী রবিবারে তিনি সেখানে উঠিয়া যাইবেন স্থির হইল।

।রবিবার প্রভাতে চা খাইতে খাইতে ব্যোমকেশ বলিল‌, শশাঙ্ক‌, এবার আমাদের তলপি তুলতে হবে। অনেকদিন হয়ে গেল।’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘এরি মধ্যে! আর দুদিন থেকে যাও না। কলকাতায় তোমার কোনো জরুরী কোজ নেই তো।’ তাঁহার কথাগুলি শিষ্টতাসম্মত হইলেও কণ্ঠস্বর নিরুৎসুক হইয়া রহিল।

ব্যোমকেশ উত্তরে বলিল‌, ‘তা হয়তো নেই। কিন্তু তবু কাজের প্রত্যাশায় দোকান সাজিয়ে বসে থাকতে হবে তো।’

0 Shares