ব্যোমকেশ ও বরদা

‘তা বটে। কবে যাবে মনে করছি?’

‘আজই। তোমার এখানে ক’দিন ভারি। আনন্দে কাটল–অনেকদিন মনে থাকবে।’

‘আজই? তা–তোমাদের যাতে সুবিধা হয়—’ শশাঙ্করাবু কিয়ৎকাল বাহিরের দিকে তাকাইয়া রহিলেন‌, তারপর একটু বিরসস্বরে কহিলেন‌, ‘সে ব্যাপারটার কিছুই হল না। জটিল ব্যাপার তাতে সন্দেহ নেই; তবু ভেবেছিলুম‌, তোমার যে রকম নাম-ডাক হয়তো কিছু করতে পারবে।’

‘কোন ব্যাপারের কথা বলছ?’

‘বৈকুণ্ঠবাবর খুনের ব্যাপার। কথাটা ভুলেই গেলে নাকি?’

‘ও-না ভুলিনি। কিন্তু তাতে জানবার কিছু নেই।’

‘কিছু নেই! তার মানে? তুমি সব জেনে ফেলেছি নাকি?’

‘তা-একরকম জেনেছি বৈ কি।’

‘সে কি! তোমার কথা তো ঠিক বুঝতে পারছি না।’ শশাঙ্কবাবু ঘুরিয়া বসিলেন।

ব্যোমকেশ ঈষৎ বিস্ময়ের সহিত বলিল‌, ‘কোন-বৈকুণ্ঠবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে যা কিছু জানবার ছিল তা তো অনেকদিন আগেই জানতে পেরেছি–তা নিয়ে এখন মাথা ঘামাবার প্রয়োজন কি?’

শশাঙ্কবাবু স্তম্ভিতভাবে তাকাইয়া রহিলেন—‘কিন্তু–অনেকদিন আগেই জানতে পেরেছ—কি বলছ তুমি? বৈকুণ্ঠবাবুর হত্যাকারী কে তা জানতে পেরেছ?’

‘সে তো গত রবিবারই জানা গেছে।’

‘তবে-তাবে-এতদিন আমায় বলনি কেন?’

ব্যোমকেশ একটু হাসিল–’ভাই‌, তোমার ভাবগতিক দেখে আমার মনে হয়েছিল যে পুলিস আমার সাহায্য নিতে চায় না; বাংলাদেশে আমরা যে-প্রথায় কাজ করি সে-প্ৰথা তোমাদের কাছে একেবারে হাস্যকর‌, আঙুলের টিপ এবং ছেড়া কাগজের প্রতি তোমাদের অশ্রদ্ধার অন্ত নেই। তাই আর আমি উপযাচক হয়ে কিছু বলতে চাইনি। লোমহর্ষণ উপন্যাস মনে করে তোমরা সমস্ত পুলিস-সম্প্রদায় যদি একসঙ্গে অট্টহাস্য শুরু করে দাও—তাহলে আমার পক্ষে সেটা কি রকম সাংঘাতিক হয়ে উঠবে একবার ভেবে দ্যাখো।’

শশাঙ্কবাবু ঢোক গিলিলেন—‘কিন্তু–আমাকে তো ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারতে। আমি তো তোমার বন্ধু! সে যাক‌, এখন কি জানতে পেরেছ শুনি।’ বলিয়া তিনি ব্যোমকেশের সম্মুখে চেয়ার টানিয়া বসিলেন।

ব্যোমকেশ চুপ করিয়া রহিল।

‘কে খুন করেছে? তাকে আমরা চিনি?’

ব্যোমকেশ মৃদু হাসিল।

তাহার উরুর উপর হাত রাখিয়া প্ৰায় অনুনয়ের কণ্ঠে শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘সত্যি বল ব্যোমকেশ‌, কে করেছে?’

‘ভূত।’

শশাঙ্কবাবু বিমূঢ় হইয়া গেলেন‌, কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন‌, ‘ঠাট্টা করছ নাকি! ভুতে খুন করেছে?’

‘অর্থাৎ-হ্যাঁ‌, তাই বটে।’

অধীর স্বরে শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘যা বলতে চাও পরিষ্কার করে বল ব্যোমকেশ। যদি তোমার সত্যি সত্যি বিশ্বাস হয়ে থাকে যে ভুতে খুন করেছে—তাহলে—’ তিনি হতাশভাবে হাত উল্টাইলেন।

ব্যোমকেশ হাসিয়া ফেলিল। তারপর উঠিয়া বারান্দায় একবার পায়চারি করিয়া বলিল‌, ‘সব কথা তোমাকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে হলে আজ আমার যাওয়া হয় না।–রাত্রিটা থাকতে হয়। আসামীকে তোমার হাতে সমর্পণ না করে দিলে তুমি বুঝবে না। আজ কৈলাসবাবু বাড়ি বদল করবেন; সুতরাং আশা করা যায় আজ রাত্রেই আসামী ধরা পড়বে।’ একটু থামিয়া বলিল‌, ‘আর কিছু নয়‌, বৈকুণ্ঠবাবুর মেয়ের জন্যই দুঃখ হয়। —যাক‌, এখন কি করতে হবে বলি শোনো।’

আশ্বিন মাস‌, দিন ছোট হইতে আরম্ভ করিয়াছে। ছ’টার মধ্যে সন্ধ্যা হয় এবং নয়টা বাজিতে না বাজিতে কেল্লার অধিবাসিবৃন্দ নিদ্ৰালু হইয়া শয্যা আশ্রয় করে। গত কয়েকদিনেই তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলাম।

সে-রত্রে নটা বাজিবার কিছু পূর্বে আমরা তিনজনে বাহির হইলাম’। ব্যোমকেশ একটা টর্চ সঙ্গে লইল‌, শশাঙ্কবাবু একজোড়া হাতকড়া পকেটে পুরিয়া লইলেন।

পথ নির্জন; আকাশে মেঘের সঞ্চার হইয়া অর্ধচন্দ্রকে ঢাকিয়া দিয়াছে। রাস্তার ধারে বহুদূর ব্যবধানে যে নিষ্প্রভ কেরাসিন-বাতি ল্যাম্পপোস্টের মাথায় জ্বলিতেছিল তাহা রাত্রির ঘনকৃষ্ণ অন্ধকারকে ঘোলাটে করিয়া দিয়াছে মাত্র। পথে জনমানবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল না।

কৈলাসবাবুর পরিত্যক্ত বাসার সম্মুখে গিয়া যখন পৌঁছিলাম তখন সরকারী খাজনাখানা হইতে নয়টার ঘণ্টা বাজিতেছে। শশাঙ্কবাবু এদিক ওদিক তাকাইয়া মৃদু শিস দিলেন; অন্ধকারের ভিতর হইতে একটা লোক বাহির হইয়া আসিল-তাহাকে দেখিতে পাইলাম না‌, অস্পষ্ট পদশব্দে বুঝিলাম। ব্যোমকেশ তাহাকে চুপি চুপি কি বলিল‌, সে আবার অন্তৰ্হিত হইয়া গেল।

আমরা সন্তৰ্পণে বাড়িতে প্রবেশ করিলাম। শূন্য বাড়ি‌, দরজা জানোলা সব খোলা—কোথাও একটা আলো জ্বলিতেছে না। প্রাণহীন শবের মত বাড়িখানা যেন নিষ্পন্দ হইয়া আছে।

পা টিপিয়া টিপিয়া উপরে উঠিয়া গেলাম। কৈলাসবাবুর ঘরের সম্মুখে ব্যোমকেশ একবার দাঁড়াইল‌, তারপর ঘরে প্রবেশ করিয়া টর্চ জ্বলিয়া ঘরের চারিদিকে ফিরাইল। ঘর শূন্য-খাট বিছানা যাহা ছিল কৈলাসবাবুর সঙ্গে সমস্তই স্থানান্তরিত হইয়াছে। খোলা জানালা-পথে গঙ্গার ঠাণ্ডা বাতাস নিরাভরণ ঘরে প্রবেশ করিতেছে।

দরজা ভেজাইয়া ব্যোমকেশ টর্চ নিবাইয়া দিল। তারপর মেঝেয় উপবেশন করিয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল‌, ‘বোসো তোমরা। কতক্ষণ প্রতীক্ষা করতে হবে কিছু ঠিক নেই‌, হয়তো রাত্রি তিনটে পর্যন্ত এইভাবে বসে থাকতে হবে। —অজিত‌, আমি টর্চ জ্বললেই তুমি গিয়ে জানালা আগলে দাঁড়াবে; আর শশাঙ্ক‌, তুমি পুলিসের কর্তব্য করবে—অর্থাৎ প্রেত্যকে প্ৰাণপণে চেপে ধরবে।’

অতঃপর অন্ধকারে বসিয়া আমাদের পাহারা আরম্ভ হইল। চুপচাপ তিনজনে বসিয়া আছি‌, নড়ন-চড়ন নাই; নড়িলে বা একটু শব্দ করিলে ব্যোমকেশ বিরক্তি প্ৰকাশ করিতেছে। সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিয়া যে সময়ের অস্ত্যেষ্টি করিব তাহারও উপায় নাই‌, গন্ধ পাইলে শিকার ভড়কাইয়া যাইবে। বসিয়া বসিয়া আর এক রাত্রির দীর্ঘ প্রতীক্ষা মনে পড়িল‌, চোরাবালির ভাঙা কুঁড়ে ঘরে অজানার উদ্দেশ্যে সেই সংশয়পূর্ণ জাগরণ। আজকার রাত্রিও কি তেমনি অভাবনীয় পরিসমাপ্তির দিকে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে?

0 Shares