ব্যোমকেশ ও বরদা

‘গত পনেরো বছর ধরে এই বাড়িতে যিনি বাস করছিলেন তাঁর নাম—-বৈকুণ্ঠ দাস। লোকটির বয়স হয়েছিল—জাতিতে স্বর্ণকার। বাজারে একটি সোনারূপার দোকান ছিল; কিন্তু দোকানটা নামমাত্র। তাঁর আসল কারবার ছিল জহরতের। হিসাবের খাতপত্র থেকে দেখা যায়‌, মৃত্যুকালে তাঁর কাছে একান্নখানা হীরা মুক্ত চুনি পান্না ছিল—যার দাম প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।

‘এই সব দামী মণি-মুক্ত তিনি বাড়িতেই রাখতেন-দোকানে রাখতেন না। অথচ আশ্চর্য এই যে তাঁর বাড়িতে একটা লোহার সিন্দুক পর্যন্ত ছিল না। কোথায় তিনি তাঁর মূল্যবান মণি-মুক্তা রাখতেন কেউ জানে না। খরিদার এলে তাকে তিনি বাড়িতে নিয়ে আসতেন‌, তারপর খরিদারকে বাইরের ঘরে বসিয়ে নিজে ওপরে গিয়ে শোবার ঘর থেকে প্রয়োজন মত জিনিস এনে দেখাতেন।

‘হীরা জহরতের বহর দেখেই বুঝতে পারছ লোকটি বড় মানুষ। কিন্তু তাঁর চাল-চলন দেখে কেউ তা সন্দেহ করতে পারত না। নিতান্ত নিরীহ গোছের আধাবয়সী লোক‌, দেবদ্বিজে অসাধারণ ভক্তি, গলায় তুলসীকঠি-সর্বদাই জোড়হস্ত হয়ে থাকতেন। কিন্তু কোন সৎকার্যের জন্য চাঁদা চাইতে গেলে এত বেশি বিমর্ষ এবং কাতর হয়ে পড়তেন যে শহরের ছেলেরা তাঁর কাছে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা ছেড়েই দিয়েছিল। তাঁর নামটাও এই সূত্রে একটু বিকৃত হয়ে পরিহাসচ্ছলে ‘ব্যয়-কুণ্ঠ’ আকার ধারণ করেছিল। শহরলুদ্ধ বাঙালী তাঁকে ব্যয়-কুণ্ঠ জহুরী বলেই উল্লেখ করত।

‘বাস্তবিক লোকটি অসাধারণ কৃপণ ছিলেন। মাসে সত্তর টাকা তাঁর খরচ ছিল‌, তার মধ্যে চল্লিশ টাকা বাড়িভাড়া; বাকি ত্ৰিশ টাকায় নিজের‌, একটি মেয়ের আর এক হাবাকালা চাকরের গ্ৰাসাচ্ছাদন চালিয়ে নিতেন; আমি তাঁর দৈনন্দিন খরচের খাতা দেখেছি‌, কখনও সত্তরের কোঠা পেরোয়নি। আশ্চর্য নয়?—আমি ভাবি‌, লোকটি যখন এতবড় কৃপণই ছিলেন তখন এত বেশি। ভাড়া দিয়ে কেল্লার মধ্যে থাকবার কারণ কি? কেল্লার বাইরে থাকলে তো ঢের কম ভাড়ায় থাকতে পারতেন।’

ব্যোমকেশ ডেক-চেয়ারে লম্বা হইয়া অদূরের পাষাণ-নির্মিত দুর্গ-তোরণের পানে তাকাইয়া শুনিতেছিল; বলিল‌, ‘কেল্লার ভিতরটা বাইরের চাইতে নিশ্চয় বেশি নিরাপদ্‌্‌, চোর-বদমাসের আনাগোনা কম। সুতরাং যার কাছে আড়াই লক্ষ টাকার জহরত আছে সে তো নিরাপদ স্থান দেখেই বাড়ি নেবে। বৈকুণ্ঠবাবু ব্যয়-কুণ্ঠ ছিলেন বটে। কিন্তু অসাবধানী লোক বোধ হয় ছিলেন না।’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘আমিও তাই আন্দাজ করেছিলুম। কিন্তু কেল্লার মধ্যে থেকেও বৈকুণ্ঠবাবু যে চোরের শেনদৃষ্টি এড়াতে পারেননি। সেই গল্পই বলছি। সম্ভবত তাঁর বাড়িতে চুরি করবার সঙ্কল্প অনেকদিন থেকেই চলছিল। মুঙ্গের জায়গাটি ছোট বটে‌, তাই বলে তাকে তুচ্ছ মনে কোরো না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না না‌, সে কি কথা!’

‘এখানে এমন দু’ চারটি মহাপুরুষ আছেন যাঁদের সমকক্ষ চৌকশ চোর দাগাবাজ খুনে তোমাদের কলকাতাতেও পাবে না। বলব কি তোমাকে‌, গভর্নমেন্টকে পর্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছে হে। এখানে মীরকাশিমের আমলের অনেক দিশী বন্দুকের কারখানা আছে জান তো? কিন্তু সে-সব কথা পরে হবে‌, আগে বৈকুণ্ঠ জহুরীর গল্পটাই বলি।’

এইভাবে সামান্য অবাস্তর কথার ভিতর দিয়া শশাঙ্কবাবু পুলিসের তথা নিজের বিবিধ গুরুতর দায়িত্বের একটা গৃঢ় ইঙ্গিত দিয়া আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন–

‘গত ছাব্বিশে এপ্রিল-অৰ্থাৎ বাংলার ১২ই বৈশাখ-বৈকুণ্ঠবাবু আটটার সময় তাঁর দোকান থেকে বাড়ি ফিরে এলেন। নিতান্তই সহজ মানুষ‌, মনে আসন্ন দুর্ঘটনার পূবাভাস পর্যন্ত নেই। আহারাদি করে রাত্রি আন্দাজ ন’টার সময় তিনি দোতলার ঘরে শুতে গেলেন। তাঁর মেয়ে নীচের তলায় ঠাকুরঘরে শুতো‌, সেও বোপকে খাইয়ে দাইয়ে ঠাকুরঘরে গিয়ে দোর বন্ধ করে দিলে। হাবাকাল চাকরিটা রাত্ৰে দোকান পাহারা দিত‌, মালিক বাড়ি ফেরবার পরই সে চলে গেল। তারপর বাড়িতে কি ঘটেছে‌, কেউ কিছু জানে না।

‘সকালবেলা যখন দেখা গেল যে বৈকুণ্ঠবাবুঘরের দোর খুলছেন না‌, তখন দোর ভেঙে ফেলা হল। পুলিস ঘরে ঢুকে দেখলে বৈকুণ্ঠবাবুর মৃতদেহ দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। কোথাও তাঁর গায়ে আঘাত-চিহ্ন নেই‌, আততায়ী গলা টিপে তাঁকে মেরেছে; তারপর তাঁর সমস্ত জহরত নিয়ে খোলা জানলা দিয়ে প্রস্থান করেছে।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আততায়ী তাহলে জানলা দিয়েই ঘরে ঢুকেছিল?’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘তই তো মনে হয়। ঘরের একটি মাত্র দরজা বন্ধ ছিল‌, সুতরাং জানলা ছাড়া ঢোকবার আর পথ কোথায়! আমার বিশ্বাস‌, বৈকুণ্ঠবাবু রাত্রে জানলা খুলে শুয়েছিলেন; গ্ৰীষ্মকাল-সে–রাত্রিটা গরমও ছিল খুব। জানলার গরাদ নেই‌, কাজেই মই লাগিয়ে চোরেরা সহজেই ঘরে ঢুকতে পেরেছিল।’

‘বৈকুণ্ঠবাবুর হীরা জহরত সবই চুরি গিয়েছিল?’

‘সমস্ত। আড়াই লক্ষ টাকার জহরত একেবারে লোপাট। একটিও পাওয়া যায়নি। এমন কি তাঁর কাঠের হাত-বাক্সে যে টাকা-পয়সা ছিল তাও চোরের ফেলে যায়নি-সমস্ত নিয়ে গিয়েছিল।’

‘কাঠের হাত-বাক্সে বৈকুণ্ঠবাবু হীরা জহরত রাখতেন?’

‘তাছাড়া রাখবার জায়গা কৈ? অবশ্য হাত-বাক্সেই যে রাখতেন তার কোনো প্ৰমাণ নেই। তাঁর শোবার ঘরে কারু ঢোকবারই হুকুম ছিল না‌, মেয়ে পর্যন্ত জানত না তিনি কোথায় কি রাখেন। কিন্তু আগেই বলেছি‌, তাঁর একটা লোহার সিন্দুক পর্যন্ত ছিল না; অথচ হীরা মুক্তা যা-কিছু সব শোবার ঘরেই রাখতেন। সুতরাং হাত-বাক্সেই সেগুলো থাকত‌, ধরে নিতে হবে।’.

0 Shares