ব্যোমকেশ ও বরদা

‘ঘরে আর কোনো বাক্স-প্যাঁটুরা বা ঐ ধরনের কিছু ছিল না?

‘কিছু না। শুনলে আশ্চর্য হবে‌, ঘরে একটা মাদুর‌, একটা বালিশ‌, ঐ হাত-বাক্সটা‌, পানের বাটা আর জলের কলসী ছাড়া কিছু ছিল না। দেয়ালে একটা ছবি পর্যন্ত না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পানের বাটা! সেটা ভাল করে দেখেছিলে তো?’

শশাঙ্কবাবু ক্ষুব্ধভাবে ঈষৎ হাসিলেন—’ওহে‌, তোমরা আমাদের যতটা গাধা মনে কর‌, সত্যিই আমরা ততটা গাধা নাই। ঘরের সব জিনিসই অতিপতি করে তল্লাস করা হয়েছিল। পানের বাটার মধ্যে ছিল একদলা চুন‌, খানিকটা করে খয়ের সুপুরি লবঙ্গ—আর পানের পাতা। বাটাটা পিতলের তৈরি‌, তাতে চুন খয়ের সুপুরির জন্য আলাদা খুবরি কাটা ছিল। বৈকুণ্ঠবাবু খুব বেশি পান খেতেন‌, অন্যের সাজা পান পছন্দ হত না বলে নিজে সেজে খেতেন।–আর কিছু জানতে চাও এ সম্বন্ধে?’

ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে বলিল‌, ‘না না‌, ওই যথেষ্ট। তোমাদের ধৈর্য আর অধ্যবসায় সম্বন্ধে তো কোনো প্রশ্ন নেই; সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে। সেই সঙ্গে যদি একটু বুদ্ধি-কিন্তু সে যাক। মোট কথা দাঁড়াল এই যে বৈকুণ্ঠবাবুকে খুন করে তাঁর আড়াই লক্ষ টাকার জহরত নিয়ে চোর কিম্বা চোরেরা চম্পট দিয়েছে। তারপর ছমাস কেটে গেছে। কিন্তু তোমরা কোনো কিনারা করতে পারোনি। জহরতগুলো বাজারে চালাবার চেষ্টা হচ্ছে কি না-সে খবর পেয়েছ?’

‘এখনো জহরত বাজারে আসেনি। এলে আমরা খবর পেতুম। চারিদিকে গোয়েন্দা আছে।’

‘বেশ। তারপর?’

‘তারপর আর কি–ঐ পর্যন্ত। বৈকুণ্ঠবাবুর মেয়ের অবস্থা বড়ই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তিনি নগদ টাকা কিছুই রেখে যেতে পারেননি; কোথাও একটি পয়সা পর্যন্ত ছিল না। দোকানের সোনা-রূপা বিক্রি করে যা সামান্য কিছু টাকা পেয়েছে সেইটুকুই সম্বল। বাঙালী ভদ্রঘরের মেয়ে‌, বিদেশে পয়সার অভাবে পরের গলগ্রহ হয়ে রয়েছে দেখলেও কষ্ট হয়।’

‘কার গলগ্রহ হয়ে আছে?’

‘স্থানীয় একজন প্রবীণ উকিল–নাম তারাশঙ্করবাবু। তিনিই নিজের বাড়িতে রেখেছেন। লোকটি উকিল হলেও ভাল বলতে হবে। বৈকুণ্ঠবাবুর সঙ্গে প্রণয়ও ছিল‌, প্রতি রবিবারে দুপুরবেলা দু’জনে দাবা খেলতেন—’

‘হঁ। মেয়েটি বিধবা?

‘না‌, সধবা। তবে বিধবা বললেও বিশেষ ক্ষতি হয় না। কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল‌, স্বামীটা অল্প বয়সে বয়াটে হয়ে যায়। মাতাল দুশ্চরিত্র–থিয়েটার যাত্রা করে বেড়াত‌, তারপর হঠাৎ নাকি এক সার্কাস পাটির সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে নিরুদ্দেশ। তাই মেয়েকে বৈকুণ্ঠবাবু নিজের কাছেই রেখেছিলেন।’

‘মেয়েটির বয়স কত?

তেইশ-চব্বিশ হবে।’

চরিত্র কেমন?’।

‘যতদূর জানি‌, ভাল। চেহারাও ভাল থাকার অনুকুল–অর্থাৎ জলার পেত্নী বললেই হয়। স্বামী বেচারাকে নেহাৎ দোষ দেওয়া যায় না–’

‘বুঝেছি। দেশে আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই?’

‘না-থাকারই মধ্যে। নবদ্বীপে খুড়তুতো ভায়েরা আছে‌, বৈকুণ্ঠবাবুর মৃত্যুর খবর পেয়ে কয়েকজন ছুটে এসেছিল। কিন্তু যখন দেখলে এক ফোঁটাও রস নেই‌, সব চোরে নিয়ে গেছে‌, তখন যে-যার খসে পড়ল।’

ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; তারপর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘ব্যাপারটার মধ্যে অনেকখানি অভিনবত্ব রয়েছে। কিন্তু এত বেশি দেরি হয়ে গেছে যে আর কিছু করতে পারা যাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আমি বিদেশী‌, দুদিনের জন্য এসেছি‌, তোমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তুমিও বোধ হয় তা পছন্দ করবে না।’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘না না‌, হস্তক্ষেপ করতে যাবে কেন? আমি অফিসিয়ালি তোমাকে কিছু বলছি না; তবে তুমিও এই কাজের কাজী‌, যদি দেখে শুনে তোমার মনে কোনো আইডিয়া আসে তাহলে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করতে পার। তুমি বেড়াতে এসেছ‌, তোমার ওপর কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে তোমাকে বিব্রত করতে আমি চাই না।’

শশাঙ্কবাবুর মনের ভাবটা অজ্ঞাত রহিল না। সাহায্য লইতে তিনি পুরাদস্তুর রাজী‌, কিন্তু ‘অফিসিয়ালি কাহারো কৃতিত্ব স্বীকার করিয়া যশের ভাগ দিতে নারাজ।

ব্যোমকেশও হাসিল‌, বলিল‌, ‘বেশ‌, তাই হবে। দায়িত্ব না নিয়েই তোমাকে সাহায্য করব।–ভাল কথা‌, ভূতের উপদ্রবের কথা কি বলছিলে?’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘বৈকুণ্ঠবাবু মারা যাবার কিছুদিন পরেই ঐ বাড়িতে আর একজন বাঙালী ভাড়াটে এসেছেন‌, তিনি আসার পর থেকেই বাড়িতে ভূতের উপদ্রব আরম্ভ হয়েছে। সব কথা অবশ্য বিশ্বাস করা যায় না‌, কিন্তু যে সব ব্যাপার ঘটছে তাতে রোমাঞ্চ হয়। পনেরো হাত লম্বা। একটি প্ৰেতাত্মা রাত্রে ঘরের জানোলা দিয়ে উঁকি মারে। বাড়ির লোক ছাড়াও আরো কেউ কেউ দেখেছে।’

‘বল কি?’

‘হ্যাঁ।–এখানে বরদাবাবু বলে এক ভদ্রলোক আছেন-আরো! নাম করতে না করতেই এসে পড়েছেন যে! অনেকদিন বাঁচবেন। শৈলেনবাবুও আছেন।–বেশ বেশ। আসুন। ব্যোমকেশ‌, বরদাবাবু হচ্ছেন্ন ভূতের একজন বিশেষজ্ঞ। ভুতুড়ে ব্যাপার ওঁর মুখেই শোনো।’

0 Shares