ব্যোমকেশ ও বরদা

প্রাথমিক নমস্কারাদির পর নবাগত দুইজন আসন গ্ৰহণ করিলেন। বরদাবাবুর চেহারাটি গোলগাল বেঁটে-খাটো‌, রং ফরসা‌, দাড়ি গোঁফ কামানো; সব মিলাইয়া নৈনিতাল আলুর কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। তাঁহার সঙ্গী শৈলেনবাবুইহার বিপরীত; লম্বা একহারা গঠন‌, অথচ ক্ষীণ বলা চলে না। কথায় বাতায় উভয়ের পরিচয় জানিতে পারিলাম। বরদাবাবু এখানকার বাসিন্দা‌, পৈতৃক কিছু জমিজমা ও কয়েকখানা বাড়ির উপস্বত্ব ভোগ করেন এবং অবসরকালে প্রেততত্ত্বের চচা করিয়া থাকেন। শৈলেনবাবু ধনী ব্যক্তি-স্বাস্থ্যের জন্য মুঙ্গেরে আসিয়াছিলেন; কিন্তু স্থানটি তাঁহার স্বাস্থ্যের সহিত এমন খাপ খাইয়া গিয়াছে যে বাড়ি কিনিয়া এখানে স্থায়ীভাবে বাস করিতে মনস্থ করিয়াছেন। বয়স উভয়েরই চল্লিশের নীচে।
আমাদের পরিচয়ও তাঁহাদিগকে দিলাম-কিন্তু দেখা গেল ব্যোমকেশের নাম পর্যন্ত তাঁহারা শোনেন নাই। খ্যাতি এমনই জিনিস!

যা হোক‌, পরিচয় আদান-প্রদানের পর বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘ব্যয়কুণ্ঠ জহুরীর গল্প শুনছিলেন বুঝি? বড়ই শোচনীয় ব্যাপার-অপঘাত মৃত্যু। আমার বিশ্বাস গয়ায় পিণ্ড না দিলে তাঁর আত্মার সদগতি হবে না।’

ব্যোমকেশ একটু নড়িয়া চড়িয়া বসিল। তাহার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘আপনি প্রেতিযোনি বিশ্বাস করেন না?’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘অবিশ্বাসও করি না। প্রেতিযোনি আমার হিসেবের বাইরে।’ বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘আপনি হিসেবের বাইরে রাখতে চাইলেও তারা যে থাকতে চায় না। ঐখানেই তো মুশকিল। শৈলেনবাবু্‌, আপনিও তো আগে ভূত বিশ্বাস করতেন না‌, বুজরুকি বলে হেসে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু এখন?

বরদাবাবুর সঙ্গী বলিলেন‌, ‘এখন গোঁড়া ভক্ত বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাস্তবিক ব্যোমকেশবাবু্‌, আগে আমিও আপনার মত ছিলুম‌, ভূত-প্ৰেত নিয়ে মাথা ঘামাতুম না। কিন্তু এখানে এসে বরদাবাবুর সঙ্গে আলাপ হবার পর যতই এ বিষয়ে আলোচনা করছি ততই আমার ধারণা হচ্ছে যে ভুতকে বাদ দিয়ে এ সংসারে চলা এরকম অসম্ভব।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কি জানি! আমাদের তো এখন পর্যন্ত বেশ চলে যাচ্ছে। আর দেখুন‌, এমনিতেই মানুষের জীবনযাত্ৰাটা এত জটিল হয়ে উঠেছে যে তার ওপর আবার–’

শশাঙ্কবাবু বাধা দিয়া বলিলেন‌, ‘ও সব যাক। বরদাবাবু্‌, আপনি ব্যোমকেশকে বৈকুণ্ঠবাবুর ভূতুড়ে কাহিনীটা শুনিয়ে দিন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, সেই ভাল। তত্ত্ব আলোচনার চেয়ে গল্প শোনা ঢের বেশি। আরামের।’

বরদাবাবুর মুখে তৃপ্তির একটা ঝিলিক খেলিয়া গেল। জগতে গল্প বলিবার লোক অনেক আছে-কিন্তু অনুরাগী শ্রোতা সকলের ভাগ্যে জোটে না। অধিকাংশই অবিশ্বাসী ও ছিদ্রান্বেষী্‌্‌, গল্প শোনার চেয়ে তর্ক করিতেই অধিক ভালবাসে। তাই ব্যোমকেশ যখন তত্ত্ব ছাড়িয়া গল্প শুনিতেই সম্মত হইল। তখন বরদাবাবু যেন অপ্রত্যাশিতের আবিভাবে উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন। বুঝিলাম‌, শিষ্ট এবং ধৈৰ্যবান শ্রোতা লাভ করা তাঁহার ভাগ্যে বড় একটা ঘটিয়া উঠে না।

শশাঙ্কবাবুর কোটা হইতে একটি সিগারেট লইয়া তাহাতে অগ্নিসংযোগপূর্বক বরদাবাবু ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিলেন। সকলের গল্প বলিবার ভঙ্গী এক নয়; বরদাবাবুর ভঙ্গীটি বেশ চিত্তাকর্ষক। হুড়াহুড়ি তাড়াতাড়ি নাই-ধীরমন্থর তালে চলিয়াছে; ঘটনার বাহুল্যে গল্প কণ্টকিত নয়‌, অথচ এরূপ নিপুণভাবে ঘটনাগুলি বিন্যস্ত যে শ্রোতার মনকে ধীরে ধীরে শৃঙ্খলিত করিয়া ফেলে। চোখের দৃষ্টি ও মুখের ভঙ্গিমা এমনভাবে গল্পের সহিত সঙ্গত করিয়া চলে যে সব মিশাইয়া একটি অখণ্ড রস বস্তুর আস্বাদ পাইতেছি বলিয়া ভ্ৰম হয়।

‘বৈকুণ্ঠবাবুর মৃত্যুর কথা আপনারা শুনেছেন। অপঘাত মৃত্যু; পরলোকের জন্য প্রস্তুত হবার অবকাশ তিনি পাননি। আমাদের মধ্যে একটা সংস্কার আছে যে‌, মানুষের আত্মা সহসা অতর্কিতভাবে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তার দেহাভিমান দূর হয় না-অৰ্থাৎ সে বুঝতেই পারে না। তার দেহ নেই। আবার কখনো কখনো বুঝতে পারলেও সংসারের মোহ ভুলতে পারে না‌, ঘুরে ফিবে তার জীবিতকালের কর্মক্ষেত্রে আনাগোনা করতে থাকে।

‘এসব থিয়োরি আপনাদের বিশ্বাস করতে বলছি না। কিন্তু যে অলৌকিক কাহিনী আপনাদের শোনাতে যাচ্ছি-এ ছাড়া তার আর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ঘটনা যে সত্য সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমি আষাঢ়ে গল্প বলি এই রকম একটা অপবাদ আছে; কিন্তু এক্ষেত্রে অতি বড় অবিশ্বাসীকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে আমি একবিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। কি বলেন। শৈলেনবাবু?’

শৈলেনবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। অমূল্যবাবুকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে ঘটনা মিথ্যে নয়।’ বরদাবাবু বলিতে লাগিলেন‌, ‘সুতরাং কারণ যাই হোক‌, ঘটনোটা নিঃসংশয়। বৈকুণ্ঠবাবু মারা যাবার পর কয়েক হগুপ্ত তাঁর বাড়িখানা পুলিসের কবলে রইল; ইতিমধ্যে বৈকুণ্ঠবাবুর মেয়েকে তারাশঙ্করবাবু নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। এ কয়দিনের মধ্যে কিছু ঘটেছিল কি না বলতে পারি না‌, পলিসের যে দু’জন কনস্টেবল সেখানে পাহারা দেবার জন্য মোতা যেন হয়েছিল তারা সম্ভবত সন্ধের পর দু’ ঘটি ভাঙি চড়িয়ে এমন নিদ্ৰা দিত যে ভূত-প্রেতের মত অশরীরী জীবের গতিবিধি লক্ষ্য করবার মত অবস্থা তাদের থাকত না। যা হোক‌, পুলিস সেখান থেকে থানা তুলে নেবার পরই একজন নবাগত ভাড়াটে বাড়িতে এলেন। ভদ্রলোকের নাম কৈলাসচন্দ্ৰ মল্লিক-রোগজীর্ণ বৃদ্ধ-স্বাস্থ্যের অন্বেষণে মুঙ্গেরে এসে কেল্লায় একখানা বাড়ি খালি হয়েছে দেখে খোঁজখবর না নিয়েই বাড়ি দখল করে বসলেন-বাড়ির মালিকও খুনের ইতিহাস তাঁকে জানাবার জন্য বিশেষ ব্যগ্রতা প্ৰকাশ করলেন না।

‘কয়েকদিন নিরুপদ্রবেই কেটে গেল। দোতলায় একটি মাত্ৰ শোবার ঘর-যে-ঘরে বৈকুণ্ঠবাবু মারা গিয়েছিলেন-সেই ঘরটিতেই কৈলাসবাবু শুতে লাগলেন। নীচের তলায় তাঁর চাকর বামুন সরকার রইল। কৈলাসবাবুর অবস্থা বেশ ভাল‌, পাড়া গেয়ে জমিদার। একমাত্র ছেলের সঙ্গে ঝগড়া চলছে‌, স্ত্রীও জীবিত নেই-তই কেবল চাকর বামুনের ওপর নির্ভর করেই হাওয়া বদলাতে এসেছেন।

‘ছয় সাত দিন কেটে যাবার পর একদিন ভূতের আবির্ভাব হল। রাত্রি নোটার সময় ওষুধ খেয়ে তিনি নিদ্রার আয়োজন করছেন‌, এমন সময় নজর পড়ল জানালার দিকে। গ্ৰীষ্মকাল‌, জানালা খোলাই ছিল—দেখলেন‌, কদাকার একখানা মুখ ঘরের মধ্যে উঁকি মারছে। কৈলাসবাবু চীৎকার করে উঠলেন‌, চাকর-বাকর নীচে থেকে ছুটে এল। কিন্তু মুখখানা তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

0 Shares