ব্যোমকেশ ও বরদা

‘তারপর আরো দুই রাত্রি ওই ব্যাপার হল। প্রথম রাত্রির ব্যাপারটা রুগ্ন কৈলাসবাবুর মানসিক ভ্ৰান্তি বলে সকলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হল না। খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের সঙ্গে তখনো কৈলাসবাবুর আলাপ হয়নি‌, কিন্তু আমরাও জানতে পারলুম।

“ভূত-প্ৰেত সম্বন্ধে আমার একটা বৈজ্ঞানিক কৌতুহল আছে। নেই বলে তাকে উড়িয়ে দিতে পারি না‌, আবার চোখ বুজে তাকে মেনে নিতেও পারি না। তাই‌, অন্য সকলে যখন ঘটনাটাকে পরিহাসের একটি সরস উপাদান মনে করে উল্লসিত হয়ে উঠলেন‌, আমি তখন ভাবলুম—দেখিই না; অপ্রাকৃত বিষয় বলে মিথ্যেই হতে হবে এমন কি মানে আছে?

‘একদিন আমি এবং আরো কয়েকজন বন্ধু কৈলাসবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলুম। তিনি রোগে পঙ্গু-হার্টের ব্যারাম-নীচে নাম ডাক্তারের নিষেধ; তাঁর শোবার ঘরেই আমাদের ডেকে পাঠালেন। খিটখিটে স্বভাবের লোক হলেও তাঁর বাহ্য আদব-কায়দা বেশ দুরন্ত্‌্‌, আমাদের ভালভাবেই অভ্যর্থনা করলেন। তাঁর কাছ থেকে ভৌতিক ব্যাপারের সঠিক ব্বিরণ পাওয়া গেল।

‘তিনি বললেন-গতি পনেরো দিনের মধ্যে চারবার প্রেতিমূর্তির আবির্ভাব হয়েছে। চারবারই সে জানালার সামনে এসে ঘরের মধ্যে উঁকি মেরেছে—তারপর মিলিয়ে গেছে। তার আসার সময়ের কিছু ঠিক নেই; কখনো দুপুর রাত্রে এসেছে‌, কখনো শেষ রাত্রে এসেছে‌, আবার কখনো বা সন্ধের সময়েও দেখা দিয়েছে। মূর্তিটা সুশ্ৰী নয়‌, চোখে একটা লুব্ধ ক্ষুধিত ভাব। যেন ঘরে ঢুকতে চায়‌, কিন্তু মানুষ আছে দেখে সাক্ষাতে ফিরে চলে যাচ্ছে।

‘কৈলাসবাবুর গল্প শুনে আমরা স্থির করলুম‌, স্বচক্ষে এই ঘটনা প্ৰত্যক্ষ করতে হবে। কৈলাসবাবুও আমাদের সাগ্রহে আমন্ত্রণ করলেন। পরদিন থেকে আমরা প্রত্যহ তাঁর বাড়িতে পাহারা আরম্ভ করলুম। সন্ধ্যে থেকে রাত্রি দশটা-কখনো বা এগারোটা বেজে যায়। কিন্তু প্রেতিয়োনির দেখা নেই। যদি বা কদাচিৎ আসে‌, আমরা চলে যাবার পর আসে; আমরা দেখতে পাই না।

‘দিন দশেক আনাগোনা করবার পর আমার বন্ধুরা একে একে খসে পড়তে লাগলেন; শৈলেনবাবুও ভগ্নোদ্যম হয়ে যাওয়া ছেড়ে দিলেন। আমি কেবল একলা লেগে রইলুম। সন্ধ্যের পর যাই; কৈলাসবাবুর সঙ্গে বসে গল্প-গুজব করি‌, তারপর সাড়ে-দশটা এগারোটা নাগাদ ফিরে আসি।

‘এইভাবে আরো এক হগুপ্ত কেটে গেল। আমিও ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়তে লাগলুম। এ কি রকম প্ৰেতাত্মা যে কৈলাসবাবু ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না। কৈলাসবাবুর ওপর নানা রকম সন্দেহ হতে লাগিল।

‘তারপর একদিন হঠাৎ আমার দীর্ঘ অধ্যবসায়ের পুরস্কার পেলুম। কৈলাসবাবুর ওপরে সন্দেহও ঘুচে গেল।’

ব্যোমকেশ এতক্ষণ একমনে শুনিতেছিল‌, বলিল‌, ‘আপনি দেখলেন?’ গভীর স্বরে বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ-আমি দেখলুম।’ ব্যোমকেশ চেয়ারে হেলান দিয়া বসিল।।–’তই তো!’ তারপর কিয়াৎকাল যেন চিন্তা করিয়া বলিল‌, ‘বৈকুণ্ঠবাবুকে চিনতে পারলেন?’

বরদাবাবু মাথা নাড়িলেন–‘তা ঠিক বলতে পারি না। —একখানা মুখ‌, খুব স্পষ্ট নয়। তবু মানুষের মত তাতে সন্দেহ নেই। কয়েক মুহুর্তের জন্যে আবছায়া ছবির মত ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভারি আশ্চর্য! প্রত্যক্ষভাবে ভুত দেখা সকলের ভাগ্যে ঘটে ওঠে না; অধিকাংশ স্থলেই ভৌতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়-হয় শোনা কথা‌, নয় তো রজ্জ্বতে সৰ্পভ্ৰম।’

ব্যোমকেশের কথার মধ্যে অবিশ্বাসের যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল তাহা বোধ করি শৈলেনবাবুকে বিদ্ধ করিল; তিনি বলিলেন‌, ‘শুধু বরদাবাবু নয়‌, তারপর আরো অনেকে দেখেছেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনিও দেখেছেন নাকি?’

শৈলেনবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ‌, আমিও দেখেছি। হয়তো বরদাবাবুর মত অত স্পষ্টভাবে দেখিনি‌, তবু দেখেছি। বরদাবাবু দেখবার পর আমরা কয়েকজন আবার যেতে আরম্ভ করেছিলুম। একদিন আমি নিমেষের জন্য দেখে ফেললুম।’

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘সেদিন শৈলেনবাবু উত্তেজিত হয়ে একটু ভুল করে ফেলেছিলেন বলেই ভাল করে দেখতে পাননি। আমরা কয়েকজন-আমি‌, অমূল্য আর ডাক্তার শচী রায়-কৈলাসবাবুর সঙ্গে কথা কইছিলুম; তাঁকে বাড়ি ছেড়ে দেবার পরামর্শ দিতে দিতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম‌, কিন্তু শৈলেনবাবু শিকারীর মত জানালার দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ উনি ‘ঐ ঐ—’ করে চেচিয়ে উঠলেন। আমরা ধড়মড় করে ফিরে চাইলুম‌, কিন্তু তখন আর কিছু দেখা গেল না। শৈলেনবাবু দেখেছিলেন‌, একটা কুয়াসার মত বাষ্প যেন ক্রমশ আকার পরিগ্রহ করছে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণরূপে materialise করবার আগেই উনি চেচিয়ে উঠলেন‌, তাই সব নষ্ট হয়ে গেল।’

শৈলেনবাবু বলিলেন‌, ‘তবু্‌, কৈলাসবাবুও নিশ্চয় দেখতে পেয়েছিলেন। মনে নেই‌, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন?’

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ‌, একে তাঁর হার্ট দুর্বল—; ভাগ্যে শচী ডাক্তার উপস্থিত ছিল‌, তাই তখনি ইনজেকশন দিয়ে তাঁর জ্ঞান ফিরিয়ে আনলে। নইলে হয়তো আর একটা ট্র্যাজেডি ঘটে যেত।’

অতঃপর প্রায় পাঁচ মিনিট আমরা সকলে নীরবে বসিয়া রহিলাম। প্ৰত্যক্ষদশীর কথা‌, অবিশ্বাস করিবার উপায় নেই। অন্তত দুইটি বিশিষ্ট ভদ্রসন্তানকে চূড়ান্ত মিথ্যাবাদী বলিয়া ধরিয়া না লইলে বিশ্বাস করিতে হয়। আবার গল্পটা এতই অপ্ৰাকৃত যে সহসা মানিয়া লইতেও মন সরে না।

অবশেষে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাহলে আপনাদের মতে বৈকুণ্ঠবাবুর প্ৰেতাত্মাই তাঁর শোবার ঘরের জানোলার কাছে দেখা দিচ্ছেন?’

0 Shares