ব্যোমকেশ ও বরদা

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘তাছাড়া আর কি হতে পারে?

বৈকুণ্ঠবাবুর মেয়ের এ বিষয়ে মতামত কি?’

‘তাঁর মতামত ঠিক বোঝা যায় না। গয়ায় পিণ্ড দেবার কথা বলেছিলুম‌, তা কিছুই করলেন না। বিশেষত তারাশঙ্করবাবু তো এসব কথা কানেই তোলেন না-ব্যঙ্গ-বিদ্যুপ করে উড়িয়ে দেন।’ বরদাবাবু একটি ক্ষোভপূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বৈকুণ্ঠবাবুর খুনের একটা কিনারা হলে হয়তো তাঁর আত্মার সদগতি হত। আমি প্রেততত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু জানি না; তবু মনে হয়‌, পরলোক যদি থাকে‌, তবে প্রেতিযোনির পক্ষে প্রতিহিংসা প্রবৃত্তিটা অস্বাভাবিক নয়।’

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘তা তো নয়ই। প্রেতিযোনির কেবল দেহ নেই‌, আত্মা তো অটুট আছে। গীতায়-নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্ৰাণি–’

বাধা দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, বৈকুণ্ঠবাবুর মেয়ের সঙ্গে আমার একবার দেখা করিয়ে দিতে পারেন? তাঁকে দু-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতুম।’

বরদাবাবু ভাবিয়া বলিলেন‌, ‘চেষ্টা করতে পারি। আপনি ডিটেকটিভ শুনলে হয়তো তারাশঙ্করবাবু আপত্তি করবেন না। আজ বার লাইব্রেরিতে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব; যদি তিনি রাজী হন‌, ওবেলা এসে আপনাকে নিয়ে যাব। তাহলে তাই কথা রইল।’

অতঃপরবরদাবাবু উঠি-উঠি করিতেছেন দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, আচ্ছা‌, আমরা ভূত দেখতে পাই না?’

বরদাবাবু বলিলেন‌, ‘একদিনেই যে দেখতে পাবেন এমন কথা বলি না; তবে দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ হয়ে লেগে থাকতে পারলে নিশ্চয় দেখবেন। চলুন না‌, আজই তারাশঙ্করবাবুর বাড়ি হয়ে আপনাদের কৈলাসবাবুর বাড়ি নিয়ে যাই। কি বলেন ব্যোমকেশবাবু?

‘বেশ কথা। ওটা দেখবার আমারও বিশেষ আগ্ৰহ আছে। আপনাদের দেশে এসেছি‌, একটা নুতন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিয়ে যেতে চাই।’

‘তাহলে এখন উঠি। দশটা বাজে। ওবেলা পাঁচটা নাগাদ আবার আসব।’ বরদাবাবু ও শৈলেনবাবু প্ৰস্থান করিবার পর শশাঙ্কবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘কি মনে হল? আশ্চর্য নয়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তোমার খুনের গল্প আর বরদাবাবুর ভূতের গল্প-দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি আজগুবি বুঝতে পারছি না।’

‘আমার খুনের গল্পে আজগুবি কোনখানটা পেলে?’ ‘ছ’মাসের মধ্যে যে খুনের কিনারা হয় না। তাকে আজগুবি ছাড়া আর কি বলব? বৈকুণ্ঠবাবু খুন হয়েছিলেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই তো? হার্টফেল করে মারা যাননি?

‘কি যে বল—; ডাক্তারের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট রয়েছে‌, গলা টিপে দম বন্ধ করে তাঁকে মারা হয়েছে। গলায় sub-cutaneous abrasions—’

‘অথচ আততায়ীর কোনো চিহ্ন নেই‌, একটা আঙুলের দাগ পর্যন্ত না। আজগুবি আর কাকে বলে? বরদাবাবুর তো তবু একটা প্রত্যক্ষদৃশ্য ভূত আছে‌, তোমার তাও নেই।’–ব্যোমকেশ উঠিয়া আলস্য ভাঙিতে ভাঙিতে বলিল‌, ‘অজিত‌, ওঠো-স্নান করে নেওয়া যাক। ট্রেনে ঘুম হয়নি; দুপুরবেলা দিব্যি একটি নিদ্ৰা না দিলে শরীর ধাতস্থ হবে না।’

অপরাহ্নে বরদাবাবু আসিলেন। তারাশঙ্করবাবু রাজী হইয়াছেন; যদিও একটি শোকসন্তপ্তা ভদ্রমহিলার উপর এইসব অযথা উৎপাত তিনি অত্যন্ত অপছন্দ করেন।

বরদাবাবুর সঙ্গে দুইজনে বাহির হইলাম। শশাঙ্কবাবু যাইতে পারিলেন না‌, হঠাৎ কি কারণে উপরওয়ালার নিকট তাঁহার ডাক পড়িয়াছে।

পথে যাইতে যাইতে বরদাবাবু জানাইলেন যে‌, তারাশঙ্করবাবু লোক নেহাৎ মন্দ নয়‌, তাঁহার মত আইনজ্ঞ তীক্ষ্ণবুদ্ধি উকিলও জেলায় আর দ্বিতীয় নাই; কিন্তু মুখ বড় খারাপ। হাকিমরা পর্যন্ত তাঁহার কটু-তিক্ত ভাষাকে ভয় করিয়া চলেন। হয়তো তিনি আমাদের খুব সাদর সংবর্ধনা করিকেন না; কিন্তু তাহা যেন আমরা গায়ে না মাখি।

প্ৰত্যুত্তরে ব্যোমকেশ একটু হাসিল। যেখানে কাযোদ্ধার করিতে হইবে সেখানে তাহার গায়ে গণ্ডারের চামড়া-কেহই তাহাকে অপমান করিতে পারে না। সংসর্গগুণে আমার তুকও বেশ পুরু হইয়া আসিতেছিল।

কেল্লার দক্ষিণ দুয়ার পার হইয়া বেলুনবাজার নামক পাড়ায় উপস্থিত হইলাম। প্রধানত বাঙালী পাড়া‌, তাহার মধ্যস্থলে তারাশঙ্করবাবুর প্রকাণ্ড ইমারৎ। তারাশঙ্করবাবু যে তীক্ষ্ণবুদ্ধি উকিল তাহাতে আর সন্দেহ রহিল না।

তাঁহার বৈঠকখানায় উপনীত হইয়া দেখিলাম তক্তপোশে ফরাস পাতা এবং তাহার উপর তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া গৃহস্বামী তাম্রকুট সেবন করিতেছেন। শীর্ণ দীঘকূিতি লোক‌, দেহে মাংসের বাহুল্য নাই বরং অভাব; কিন্তু মুখের গঠন ও চোখের দৃষ্টি অতিশয় ধারালো। বয়স ষাটের কাছাকাছি; পরিধানে থান ও শুভ্ৰ পিরান। আমাদের আসিতে দেখিয়া তিনি গড়গড়ার নল হাতে উঠিয়া বসিলেন‌, বলিলেন‌, ‘এস বরদা। এঁরাই বুঝি কলকাতার ডিটেকটিভ?

ইহার কণ্ঠস্বর ও কথা বলিবার ভঙ্গীতে এমন একটা কিছু আছে যাহা শ্রোতার মনে অস্বস্তি ও অস্বচ্ছন্দ্যের সৃষ্টি করে। সম্ভবত বড় উকিলের ইহা একটা লক্ষণ; বিরুদ্ধ পক্ষের সাক্ষী এই কণ্ঠস্বর শুনিয়া যে রীতিমত বিচলিত হইয়া পড়ে তাহা অনুমান করিতে কষ্ট হইল না।

বরদাবাবু সঙ্কুচিতভাবে ব্যোমকেশের পরিচয় দিলেন। ব্যোমকেশ বিনীতভাবে নমস্কার করিয়া বলিল‌, ‘আমি একজন সত্যান্বেষী।’

তারাশঙ্করবাবুর বাম ভ্রূর প্রান্ত ঈষৎ উত্থিত হইল‌, বলিলেন‌, ‘সত্যান্বেষী? সেটা কি?’

ব্যোমকেশ কহিল‌, ‘সত্য অন্বেষণ করাই আমার পেশা-আপনার যেমন ওকালতি।’

তারাশঙ্করবাবুর অধরোষ্ঠ শ্লেষ-হাস্যে বক্র হইয়া উঠিল; তিনি বলিলেন‌, ‘ও-আজকাল ডিটেকটিভ কথাটার বুঝি আর ফ্যাশন নেই? তা আপনি কি অন্বেষণ করে থাকেন?

0 Shares