‘সত্য।’
‘তা তো আগেই শুনেছি। কোন ধরনের সত্য?’
ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘এই ধরুন, বৈকুণ্ঠবাবু আপনার কাছে কত টাকা জমা রেখে গেছেন–এই ধরনের সত্য জানতে পারলেও আপাতত আমার কাজ চলে যাবে।’
নিমেষের মধ্যে শ্লেষ-বিদ্রূপের সমস্ত চিহ্ন তারাশঙ্করবাবুর মুখ হইতে মুছিয়া গেল। তিনি
‘বৈকুণ্ঠ আমার কাছে টাকা রেখে গেছে, একথা। আপনি জানলেন কি করে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি সত্যান্বেষী।’
এক মিনিট কাল তারাশঙ্করবাবু নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তারপর যখন কথা কহিলেন তখন তাঁহার কণ্ঠস্বর একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে; সন্ত্রম-প্ৰশংসা মিশ্রিত কণ্ঠে কহিলেন, ‘ভারি আশ্চর্য! এরকম ক্ষমতা আমি আজ পর্যন্ত কারুর দেখিনি। —বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?—বোসো বরদা। বলি, ব্যোমকেশবাবুরও কি তোমার মত পোষা ভূত-টুত আছে নাকি?’
আমরা চৌকিতে উপবেশন করিলে তারাশঙ্করবাবু কয়েকবার গড়গড়ার নিলে ঘন ঘন টান দিয়া মুখ তুলিলেন, ব্যোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, ‘অবশ্য আন্দাজে ঢ়িল ফেলেছেন, এখন বুঝতে পারছি। কিন্তু আন্দাজটা পেলেন কোথায়? অনুমান করতে হলেও কিছু মাল-মশলা চাই তো।
ব্যোমকেশ সহাস্যে বলিল, ‘কিছু মাল-মশলা তো ছিল। বৈকুণ্ঠবাবুর মত ধনী ব্যবসায়ী নগদ টাকা কিছু রেখে যাবেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? অথচ ব্যাঙ্কে তাঁর টাকা ছিল না। সম্ভবত ব্যাঙ্ক-জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে তিনি সন্দেহের চক্ষে দেখতেন। তবে কোথায় টাকা রাখতেন? নিশ্চয় কোনো বিশ্বাসী বন্ধুর কাছে। বৈকুণ্ঠবাবু প্রতি রবিবারে দুপুরবেলা আপনার সঙ্গে দাবা খেলতে আসতেন। তিনি মারা যাবার পর তাঁর মেয়েকে আপনি নিজের আশ্রয়ে রেখেছেন; সুতরাং বুঝতে হবে, আপনিই তাঁর সবচেয়ে বিশ্বাসী এবং বিশ্বাসভাজন বন্ধু।’
তারাশঙ্করবাবু বলিলেন, ‘আপনি ঠিক ধরেছেন। ব্যাঙ্কের ওপর বৈকুণ্ঠের বিশ্বাস ছিল না। তার নগদ টাকা। যা-কিছু সব আমার কাছেই থাকত এবং এখনো আছে। টাকা বড় কম নয়, প্ৰায় সতের হাজার। কিন্তু এ টাকার কথা আমি প্রকাশ করিনি; তার মৃত্যুর পর কথাটা জানাজানি হয় আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ব্যোমকেশবাবু যখন ধরে ফেলেছেন তখন স্বীকার না করে উপায় নেই। তবু আমি চাই, যেন বাইরে কথাটা প্রকাশ না হয়। আপনারা তিনজন জানলেন; আর কেউ যেন জানতে না পারে। বুঝলে বরদা?’
বরদাবাবু দ্বিধা-প্রতিবিম্বিত মুখে ঘাড় নাড়িলেন।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কথাটা গোপন রাখবার কোনো বিশেষ কারণ আছে কি?’
তারাশঙ্করবাবু পুনরায় বারকয়েক তামাক টানিয়া বলিলেন, ‘আছে। আপনারা ভাবতে পারেন আমি বন্ধুর গচ্ছিত টাকা আত্মসাৎ করবার চেষ্টা করছি, কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কথাটা চেপে রাখবার অন্য কারণ আছে।’ ‘সেই কারণটি জানতে পারি না কি? তারাশঙ্করবাবু কিছুক্ষণ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া চিন্তা করিলেন; তারপর অন্দরের দিকের পদািঢাকা দরজার প্রতি একবার কাটোক্ষপাত করিয়া খাটো গলায় বলিলেন, ‘আপনারা বোধ হয় জানেন না, বৈকুণ্ঠের একটা বকাটে লক্ষ্মীছাড়া জামাই আছে। মেয়েটাকে নেয় না, স্যাকসি পার্টির সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। উপস্থিত সে কোথায় আছে জানি না, কিন্তু সে যদি কোন গতিকে খবর পায় যে তার স্ত্রীর হাতে অনেক টাকা এসেছে তাহলে মেয়েটাকে জোর করে নিয়ে যাবে। দুদিনে টাকাগুলো উড়িয়ে আবার সরে পড়বে। আমি তা হতে দিতে চাই না–বুঝলেন?’
ব্যোমকেশ ফরাসের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল, ‘বুঝেছি।’
তারাশঙ্করবাবু বলিতে লাগিলেন, ‘বৈকুণ্ঠের যথাসর্বস্ব তো চোরে নিয়ে গেছে, বাকি আছে কেবল এই হাজার কয়েক টাকা। এখন জামাই বাবাজী এসে যদি এগুলোকে ফুঁকে দিয়ে যান, তাহলে অভাগিনী মেয়েটা দাঁড়াবে কোথায়? সারা জীবন ওর চলবে কি করে? আমি তো আর চিরদিন বেঁচে থাকব না।’
ব্যোমকেশ গালে হাত দিয়া শুনিতেছিল, বলিল, ‘ঠিক কথা। তাঁকে গোটকয়েক কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই। তিনি বাড়িতেই আছেন তো? যদি অসুবিধা না হয়—’
‘বেশ। তাকে জেরা করে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু আপনি যখন চান, এইখানেই তাকে নিয়ে আসছি।’ বলিয়া তারাশঙ্করবাবু অন্দরে প্রবেশ করিলেন।
তিনি প্রস্থান করিলে আমি চক্ষু এবং ভ্রূর সাহায্যে ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলাম-প্রত্যুত্তরে সে ক্ষীণ হাসিল। বরদাবাবুর সম্মুখে খোলাখুলি বাক্যালাপ হয়তো সে পছন্দ করিবে না, তাই স্পষ্টভাবে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগিতে লাগিল—তারাশঙ্করবাবু লোকটি কি রকম?
পাঁচ মিনিট পরে তিনি ফিরিয়া আসিলেন; তাঁহার পশ্চাতে একটি যুবতী নিঃশব্দে দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মাথায় একটু আধ-ঘোমটা, মুখ দেখিবার পক্ষে কোনো প্ৰতিবন্ধক নাই; পরিধানে অতি সাধারণ সধবার সাজ। চেহারা একেবারে জলার পেত্নী না হইলেও সুশ্ৰী বলা চলে না। তবু চেহারার সবাপেক্ষা বড় দোষ বোধ করি মুখের পরিপূর্ণ ভাবহীনতা। এমন ভাবলেশশূন্য মুখ চীন-জাপানের বাহিরে দেখা যায় কি না সন্দেহ। মুখাবয়বের এই প্রাণহীনতাই রূপের অভাবকে অধিক স্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছে। যতক্ষণ সে আমাদের সম্মুখে রহিল, একবারও তাহার মুখের একটি পেশী কম্পিত হইল না, চক্ষু পলকের জন্য মাটি হইতে উঠিল না, ব্যঞ্জনাহীন নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বোমকেশের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়া যন্ত্রচালিতের মত পদার আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল।