ব্যোমকেশ ও বরদা

যা হোক‌, সে আসিয়া দাঁড়াইতেই ব্যোমকেশ সেই দিকে ফিরিয়া ক্ষিপ্ৰদৃষ্টিতে তাহার আপাদমস্তক দেখিয়া লইল; তারপর সহজ স্বরে প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনার বাবার মৃত্যুতে আপনি যে একেবারে নিঃস্ব হননি তা বোধ হয় জানেন?

‘হাঁ।’

‘তারাশঙ্করবাবু নিশ্চয় আপনাকে বলেছেন যে আপনার সতের হাজার টাকা তাঁর কাছে জমা আছে?’

‘হাঁ।’

ব্যোমকেশ যেন একটু দমিয়া গেল। একটু ভাবিয়া আবার আরম্ভ করিল‌, ‘আপনার স্বামী কতদিন নিরুদেশ হয়েছেন?’

‘আট বছর।’

‘এই আট বছরের মধ্যে আপনি তাঁকে দেখেননি?’

‘না।’

‘তাঁর চিঠিপত্রও পাননি?’

‘না।’

‘তিনি এখন কোথায় আছেন জানেন না?’

‘না।’

‘আপনি পৈতৃক টাকা পেয়েছেন জানাজানি হলে তিনি ফিরে এসে আপনাকে নিয়ে যেতে চাইবেন-এ সম্ভাবনা আছে কি?’

কিছুক্ষণ নীরব। তারপর–

‘হাঁ।’

‘আপনি তাঁর কাছে যেতে চান না?’

‘না।’

লক্ষ্য করিলাম তারাশঙ্করবাবু নিগূঢ় হাস্য করিলেন।

ব্যোমকেশ আবার অন্য পথ ধরিল।

‘আপনার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?

‘যশোরে।’

‘স্বশুরবাড়িতে কে আছে?’

‘কেউ না।’

‘শ্বশুর-শাশুড়ি?’

‘মারা গেছেন।’

‘আপনার বিয়ে হয়েছিল কোথা থেকে?’

‘নবদ্বীপ থেকে।’

নিবদ্বীপে আপনার খুড়তুত জাঠতুত ভায়েরা আছে‌, তাদের সংসারে গিয়ে থাকেন না কেন?’

উত্তর নাই।

‘তাদের আপনি বিশ্বাস করেন না?’

‘না।’

‘তারাশঙ্করবাবুকেই সবচেয়ে বড় বন্ধু মনে করেন?

‘হাঁ।’

ব্যোমকেশ ভ্রূকুটি করিয়া কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকাইয়া রহিল, তারপর আবার অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করিল–

‘আপনার বাবার মৃত্যুর পর গয়ায় পিণ্ড দেবার প্রস্তাব বরদাবাবু করেছিলেন। রাজী হননি কেন?’

নিরুত্তর।

‘ওসব আপনি বিশ্বাস করেন না?’

তথাপি উত্তর নাই।

‘যাক। এখন বলুন দেখি‌, যে-রাত্রে আপনার বাবা মারা যান‌, সে-রাত্রে আপনি কোনো শব্দ শুনেছিলেন?’

‘না।’

‘হীরা জহরত তাঁর শোবার ঘরে থাকত?’

‘হাঁ।’

‘কোথায় থাকত?

‘জানি না।’

‘আন্দাজ করতেও পারেন না?’

‘না।’

‘তাঁর সঙ্গে কোনো লোকের শত্ৰুতা ছিল?’

‘জানি না।’

‘আপনার বাবা আপনার সঙ্গে ব্যবসার কথা কখনো কইতেন না?’

‘না।’

‘রাত্রে আপনার শোবার ব্যবস্থা ছিল নীচের তলায়। কোন ঘরে শুতেন?’

‘বাবার ঘরের নীচের ঘরে।’

‘তাঁর মৃত্যুর রাত্রে আপনার নিদ্রার কোনো ব্যাঘাত হয়নি?’

‘না।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, আপনি এখন যেতে পারেন।’

অতঃপর তারাশঙ্করবাবুর বাড়িতে আমাদের প্রয়োজন শেষ হইয়া গেল। আমরা উঠিলাম। বিদায়কালে তারাশঙ্করবাবু সদয়কণ্ঠে ব্যোমকেশকে বলিলেন‌, ‘আমার কথা যে আপনি যাচাই করে নিয়েছেন এতে আমি খুশিই হয়েছি। আপনি ইশিয়ার লোক; হয়তো বৈকুণ্ঠের খুনের কিনারা করতে পারবেন। যদি কখনো সাহায্য দরকার হয় আমার কাছে আসবেন। আর মনে রাখবেন‌, গচ্ছিত টাকার কথা যেন চাউর না হয়। চাউর করলে বাধ্য হয়ে আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে।’

রাস্তায় বাহির হইয়া কেল্লার দিকে ফিরিয়া চলিলাম। দিবালোক তখন মুদিত হইয়া আসিতেছে; পশ্চিম আকাশ সিন্দুর চিহ্নিত আরশির মত ঝকঝকি করিতেছে। তাহার মাঝখানে বাঁকা চাঁদের রেখা-যেন প্ৰসাধন-রাত রূপসীর হাসির প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে!

ব্যোমকেশের কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি নাই‌, সে বুকে ঘাড় গুজিয়া চলিয়াছে। পাঁচ মিনিট নীরবে চলিবার পর আমি তাহাকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, তারাশঙ্করবাবুকে কি রকম বুঝলে?’

ব্যোমকেশ আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া হঠাৎ হাসিয়া উঠিল; বলিল‌, ‘ভারি বিচক্ষণ লোক।’

কেল্লায় প্রবেশ করিয়া বাঁহাতি যে রাস্তাটা গঙ্গার দিকে গিয়াছে‌, তাহারি শেষ প্ৰান্তে কৈলাসবাবুর বাড়ি। স্থানটি বেশ নির্জন। অনুচ্চ প্রাচীর-ঘেরা বাগানের চারিদিকে কয়েকটি ঝাউ ও দেবদারু গাছ‌, মাঝখানে ক্ষুদ্র দ্বিতল বাড়ি। বৈকুণ্ঠবাবুকে যে ব্যক্তি খুন করিয়াছিল‌, বাড়িটির অবস্থিতি দেখিয়া মনে হয় ধরা পড়িবার ভয়ে তাহাকে বিশেষ দুশ্চিন্তাগ্ৰস্ত হইতে হয় নাই।

বরদাবাবু আমাদের লইয়া একেবারে উপরতলায় কৈলাসবাবুর শয়নকক্ষে উপস্থিত হইলেন। ঘরটি সম্পূর্ণ নিরাভরণ; মধ্যস্থলে একটি লোহার খাট বিরাজ করিতেছে এবং সেই খাটের উপর পিঠে বালিশ দিয়া কৈলাসবাবু বসিয়া আছেন।

একজন ভৃত্য কয়েকটা চেয়ার আনিয়া ঘরের আলো জ্বালিয়া দিয়া প্রস্থান করিল। ছাদ হইতে ঝুলানো কেরাসিন ল্যাম্পের আলোয় প্রায়ান্ধকার ঘরের ধূসর অবসন্নতা কিয়ৎ পরিমাণে দূর হইল। মুঙ্গেরে তখনো বিদ্যুৎ-বিভার আবির্ভাব হয় নাই।

কৈলাসবাবুর চেহারা দেখিয়া তিনি রুগ্ন এ বিষয়ে সংশয় থাকে না। তাঁহার রং বেশ ফিসার্চ কিন্তু রোগের প্রভাবে মোমের মত একটা অর্ধ-স্বচ্ছ পাণ্ডুরতা মুখের বর্ণকে যেন নিষ্প্রাণ করিয়া দিয়াছে। মুখে সামান্য ছাঁটা দাড়ি আছে‌, তাহাতে মুখের শীর্ণতা যেন আরো পরিস্ফুট। চোখের দৃষ্টিতে অশান্ত অনুযোগ উকিঝুকি মারিতেছে‌, কণ্ঠস্বরও দীর্ঘ রোগভোগের ফলে একটা অপ্রসন্ন তীক্ষ্ণতা লাভ করিয়াছে।

পরিচয় আদান-প্ৰদান শেষ হইলে আমরা উপবেশন করিলাম; ব্যোমকেশ জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। ঘরের ঐ একটিমাত্র জানালা-পশ্চিমমুখী; নীচে বাগান। দেবদারু গাছের ফাঁকে ফাঁকে দূরে গঙ্গার স্রোত-রেখা দেখা যায়। এদিকে আর লোকালয় নাই‌, বাগানের পাঁচল পার হইয়াই গঙ্গার চড়া আরম্ভ হইয়াছে।

ব্যোমকেশ বাহিরের দিকে উঁকি মারিয়া বলিল‌, ‘জানালাটা মাটি থেকে প্রায় পনের হাত উঁচু। আশ্চর্য বটে।’ তারপর ঘরের চারিপাশে কৌতুহলী দৃষ্টি হানিতে হানিতে চেয়ারে আসিয়া বসিল।

0 Shares