কিছুক্ষণ কৈলাসবাবুর সঙ্গে ভৌতিক ব্যাপার সম্বন্ধে আলোচনা হইল; নূতন কিছুই প্রকাশ পাইল না। কিন্তু দেখিলাম কৈলাসবাবু লোকটি অসাধারণ একগুঁয়ে। ভৌতিক কাণ্ড তিনি অবিশ্বাস করেন না; বিলক্ষণ ভয় পাইয়াছেন তাহাও তাঁহার কথার ভাবে প্ৰকাশ পাইল। কিন্তু তবু কোনোক্রমেই এই হানাবাড়ি পরিত্যাগ করিবেন না। ডাক্তার তাঁহার হৃদযন্ত্রের অবস্থা বিবেচনা করিয়া এবাড়ি ত্যাগ করিবার উপদেশ দিতেছেন, তাঁহার সহচরেরাও ভীত হইয়া মিনতি করিতেছে, কিন্তু তিনি রুগ্ন শিশুর মত অহেতুক জিদ ধরিয়া এই বাড়ি কামড়াইয়া পড়িয়া আছেন। কিছুঁতেই এখান হইতে নড়িবেন না।
হঠাৎ কৈলাসবাবু একটা আশ্চর্য কথা বলিয়া আমাদের চমকিত করিয়া দিলেন। তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ খিটখিটে স্বরে বলিলেন, ‘সবাই আমাকে এবাড়ি ছেড়ে দিতে বলছে। আরো বাপু্, বাড়ি ছাড়লে কি হবে–আমি যেখানে যাব, সেখানেই যে এই ব্যাপার হবে। এসব অলৌকিক কাণ্ড কোন ঘটছে তা তো আর কেউ জানে না; সে কেবল আমি জানি। আপনারা ভাবছেন, কোথাকার কোন বৈকুণ্ঠবাবুর প্ৰেতাত্মা এখানে আনাগোনা করছে। মোটেই তা নয়-এর ভেতর অন্য কথা আছে।’
উৎসুকভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি রকম?
‘বৈকুণ্ঠ-ফৈকুণ্ঠ সব বাজে কথা—এ হচ্ছে পিশাচ। আমার গুণধর পুত্রের কীর্তি।’
‘সে কি!’
কৈলাসবাবুর মোমের মত গণ্ডে ঈষৎ রক্ত সঞ্চার হইল, তিনি সোজা হইয়া বসিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলিলেন, ‘হ্যাঁ, লক্ষ্মীছাড়া একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। ভদ্রলোকের ছেলে, জমিদারের একমাত্র বংশধর-পিশাচসিদ্ধ হতে চায়! শুনেছেন কখনো? হতভাগাকে আমি ত্যাজ্যপুত্ৰ করেছি, তাই আমার ওপর রিষ। তার একটা মহাপাষণ্ড গুরু জুটেছে, শুনেছি, শ্মশানে বসে বসে মড়ার খুলিতে করে মদ খায়। একদিন আমার ভদ্রাসনে চড়াও হয়েছিল; আমি দরোয়ান দিয়ে চাবকে বার করে দিয়েছিলুম। তাই দু’জনে মিলে ষড় করে আমার পিছনে পিশাচ লেলিয়ে দিয়েছে।’
‘কিন্তু—’
‘কুলাঙ্গার সন্তান–তার মতলবটা বুঝতে পারছেন না? আমার বুকের ব্যামো আছে, পিশাচ দেখে আমি যদি হার্টফেল করে মরি–ব্যস! মাণিক আমার নিষ্কণ্টকে প্রেতসিদ্ধ শুরুকে নিয়ে বিষয় ভোগ করবেন।’ কৈলাসবাবু তিক্তকণ্ঠে হাসিলেন; তারপর সহসা জানালার দিকে তাকাইয়া বিস্ফারিত চক্ষে বলিয়া উঠিলেন, ‘ঐ-ঐ—’
আমরা জানালার দিকে পিছন ফিরিয়া কৈলাসবাবুর কথা শুনিতেছিলাম, বিদ্যুদ্বেগে জানালার দিকে ফিরিলাম। যাহা দেখিলাম–তাহাতে বুকের রক্ত হিম হইয়া যাওয়া বিচিত্র নয়। বাহিরে তখন অন্ধকার হইয়া গিয়াছে; ঘরের অনুজ্জ্বল কেরাসিন ল্যাম্পের আলোকে দেখিলাম, জানালার কালো ফ্রেমে আটা একটা বীভৎস মুখ। অস্থিসার মুখের বর্ণ পাণ্ডুপীত, অধরোষ্ঠের ফাঁকে কয়েকটা পীতবর্ণ দাঁত বাহির হইয়া আছে; কালিমা-বেষ্টিত চক্ষুকোটর হইতে দুইটা ক্ষুধিত হিংস্র। চোখের পৈশাচিক দৃষ্টি যেন ঘরের অভ্যন্তরটাকে গ্ৰাস করিবার চেষ্টা করিতেছে।
মুহুর্তের জন্য নিশ্চল পক্ষাহত হইয়া গেলাম। তারপর ব্যোমকেশ দুই লাফে জানালার সম্মুখীন হইল। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর মুখ তখন অদৃশ্য হইয়াছে।
আমিও ছুটিয়া বোমকেশের পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। বাহিরের অন্ধকারে দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া মনে হইল যেন দেবদারু গাছের ঘন ছায়ার ভিতর দিয়া একটা শীর্ণ অতি দীর্ঘ মূর্তি শূন্যে মিলাইয়া গেল।
ব্যোমকেশ দেশলাই জ্বালিয়া জানালার বাহিরে ধরিল। গলা বাড়াইয়া দেখিলাম নীচে মই বা তজাতীয় আরোহণী কিছুই নাই। এমন কি, মানুষ দাঁড়াইতে পারে এমন কাৰ্ণিশ পর্যন্ত দেয়ালে নাই।
ব্যোমকেশের কাঠি নিঃশেষ হইয়া নিবিয়া গেল। সে ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া চেয়ারে বসিল।
বরদাবাবু বসিয়াছিলেন, উঠেন নাই। এখন ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, ‘দেখলেন?’
‘দেখলুম।’
বরদাবাবু গভীরভাবে একটু হাসিলেন, তাঁহার চোখে গোপন বিজয়গর্ব স্পষ্ট হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি রকম মনে হল?’
কৈলাসবাবু জবাব দিলেন। তিনি বালিশে ঠেস দিয়া প্ৰায় শুইয়া পড়িয়াছিলেন, হতাশামিশ্রিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, ‘কি আর মনে হবে–এ পিশাচ। আমাকে না নিয়ে ছাড়বে না। ব্যোমকেশবাবু্, আমার যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। পিশাচের হাত থেকে কেউ কখনো উদ্ধার পেয়েছে শুনেছেন কি?’ তাঁহার ভয়বিশীর্ণ মুখের পানে চাহিয়া আমার মনে হইল, সত্যিই ইহার সময় আসন্ন হইয়াছে, দুর্বল হৃদযন্ত্রের উপর এরূপ স্নায়ুবিক ধাক্কা সহ্য করিতে পরিবেন না।
ব্যোমকেশ শাস্তস্বরে বলিল, ‘দেখুন, ভয়টাই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্ৰু-প্ৰেত-পিশাচ নয়। আমি বলি, বাড়িটা না হয় ছেড়েই দিন না।’
বরদাবাবু বলিলেন, ‘আমিও তাই বলি। আমার বিশ্বাস, এ বাড়িতে দোষ লেগেছে-পিশাচ-টিশাচ নয়। বৈকুণ্ঠবাবুর অপঘাত মৃত্যুর পর থেকে–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পিশাচই হোক আর বৈকুণ্ঠবাবুই হোন—মোট কথা, কৈলাসবাবুর শরীরের যে রকম অবস্থা তাতে হঠাৎ ভয় পাওয়া ওঁর পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। অতএব এ বাড়ি ছাড়াই কর্তব্য।’
‘আমি বাড়ি ছাড়ব না।’ কৈলাসবাবুর মুখে একটা অন্ধ একগুয়েমি দেখা দিলে—‘কেন বাড়ি ছাড়ব? কি করেছি। আমি যে অপরাধীর মত পালিয়ে বেড়াব? আমার নিজের ছেলে যদি আমার মৃত্যু চায়-বেশ, আমি মরব। পিতৃহত্যার পাপকে যে কুসন্তানের ভয় নেই, তার বাপ হয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না।’