মগ্নমৈনাক

‘অসম্ভব বলিনি।’ ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে আলিসার ধারা দিয়া পরিক্রমণ করিল। ভারাগুলি মাটি হইতে ছাদ পর্যন্ত মই রচনা করিয়াছে‌, একটু শক্ত-সমর্থ মানুষ সহজেই মই দিয়া উপরে উঠিয়া আসিতে পারে।

ছাদ পরিদর্শন শেষ করিয়া ব্যোমকেশ ঈষৎ নিরাশ স্বরে বলিল‌, অনেক রাত হয়েছে‌, আজ এই পর্যন্ত থাক। —হেনীর ঘরটা কি সীল করবে?’

এ কে রে বলিলেন‌, ‘সীল করার দরকার দেখি না। ও-ঘরে হেনার মৃত্যুর হয়নি। উপরন্তু আমরা দু’জনেই ঘরটা খানাতল্লাশ করেছি।’

ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না। এ কে রে আলো নিভাইয়া সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিলেন‌, আমরা তাঁহার পিছনে চলিলাম।

নিঃশব্দে নামিতেছি। দ্বিতল পর্যন্ত নামিয়া মোড় ঘুরিবার উপক্রম করিতেছি‌, পাশের দিক হইতে একটা চাপা তীক্ষ্ণ স্বর কানে আসিল—’তুমি চুপ করে থাকবে‌, কোনো কথা কইবে না।’

চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া দেখি দ্বিতলে হল-ঘরের অন্য প্রাস্তে রবিবর্মার্ণ ও শ্ৰীমতী চামেলি মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছেন। রবিবর্মা আমাদের দেখিতে পাইয়া বোধহয় নিঃশব্দে শ্ৰীমতী চামেলিকে ইশারা করিল, তিনি আমাদের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। তারপর ধারালো চোখে প্রখর অসহিষ্ণুতা ফুটাইয়া তিনি দ্রুতপদে পিছনের একটি ঘরে প্রবেশ করিলেন।

নীচে নামিয়া আসিয়া ব্যোমকেশ এ কে রে’র দিকে বঙ্কিম কটাক্ষপাত করিয়া বলিল‌, ‘শুনলে?’

এ কে রে একটু ঘাড় নাড়িলেন‌, বলিলেন‌, ‘চল‌, পুলিস-ভ্যানে তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাই।’

পরদিন রবিবার সকাল সাতটার সময় ব্যোমকেশ ও আমি সবেমাত্র চায়ের পেয়ালা লইয়া বসিয়াছি‌, হুড়মুড় শব্দে নেংটি ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল‌, ‘ব্যোমকেশদা‌, ভীষণ কাণ্ড!’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, ‘ভীষণ কাণ্ড!’

নেংটি বলিল‌, ‘হ্যাঁ। একটা সিগারেট দিন।’

ব্যোমকেশ সিগারেট দিল‌, নেংটি তাহা ধরাইয়া দুই-তিনটা লম্বা টান দিয়া বলিল‌, ‘কাল রাত্তিরে হেনার ঘরটা কে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।’

আমি বলিলাম‌, ‘অ্যাঁ! বাড়ি পুড়ে গেছে!’

নেংটি বলিল‌, ‘বাড়ি নয়‌, শুধু হেনার ঘরটা পুড়েছে। খাট-বিছানা‌, টেবিল-আলমারি কিছু নেই‌, সব ছাই হয়ে গেছে।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল‌, শেষে বলিল‌, ‘রাত্তিরে কখন তোমরা জানতে পারলে?’

নেংটি বলিল‌, ‘আমরা রাত্তিরে জানিব কোথেকে‌, আমরা তো দোতলায় শুই। রবিবর্মা নীচের তলায় শোয়‌, সে-ই কিছু জানতে পারেনি। একেবারে সকালবেলায় জনাজানি হল।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কি‌, বাড়িতে চেঁচামেচি হৈ হৈ চলছে। আমি স্যুট করে পালিয়ে এসেছি আপনাকে খবর দিতে।’

‘হুঁ। কে ঘরে আগুন দিতে পারে‌, বাড়ির লোক না বাইরের লোক?’

‘তা আমি কি করে বলব? রাত্তিরে নীচের তলার দরজা-জানালা সব বন্ধ থাকে।’

‘সকালে যখন দেখলে তখন কি হেনার ঘরের জানোলা দুটো খোলা ছিল?’

‘দরজা-জানালা সব পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে‌, খোলা ছিল কি বন্ধ ছিল বোঝবার উপায় নেই। তবে–’ বলিয়া নেংটি থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘তবে কি?’

নেংটির সিগারেট আধাআধি পুড়িয়ছিল‌, বাকি অর্ধেক নিভাইয়া সে সযত্নে পকেটে রাখিল‌, বলিল‌, ‘সিঁড়ির তলায় এক টিন পেট্রোল রাখা থাকতো‌, দেখা গেল টিন খালি।’

‘তার মানে—’ ব্যোমকেশ কথা অসমাপ্ত রাখিয়া চিন্তার মধ্যে ডুবিয়া গেল।

নেংটি উঠিয়া পড়িল‌, বলিল‌, ‘আমি পালাই। মাসিমা যদি জানতে পারে আমি বাড়ি নেই, রক্ষে থাকবে না।’

ব্যোমকেশ মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘বোসো। তোমাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’

নেংটি অনিচ্ছাভরে বসিয়া বলিল‌, ‘আর কি জিজ্ঞেস করবেন‌, যা জানি সব বলেছি। এবার আপনি বুদ্ধি খাটিয়ে বের করুন‌, কে খুন করেছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘খুন করেছে তার কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু সে যাক। যে-সময় হেনা ছাদ থেকে পড়ে যায় সে-সময় তুমি কোথায়?’

নেংটি বলিল‌, ‘আমি বাড়ির মধ্যে ছিলাম না‌, সিগারেট খেতে বেরিয়েছিলাম।’

‘কি করে জানলে যে‌, তুমি যখন সিগারেট খেতে বেরিয়েছিলে ঠিক সেই সময় হেনা ছাদ থেকে পড়ে যায়?’

‘শুনুন। সাড়ে পাঁচটার একটু আগে আমি যখন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি‌, তখন হেনার ঘরের দোর একটু ফাঁক হয়ে ছিল‌, দেখলাম সে খাটে বসে কাঠি দিয়ে পশমের গেঞ্জি বুনছে। আধঘণ্টা পরে যখন ফিরে এলাম‌, তখন বাড়িতে ভীষণ কাণ্ড‌, সবেমাত্র হেনরি লাশ পাওয়া গেছে।’

‘কে লাশ পেয়েছিল?’

‘রবিবর্মা।’

‘তুমি যখন বেরুচ্ছিলে তখন হল-ঘরে আর কেউ ছিল?’

‘উদয়দা ছিল‌, আর কেউ ছিল না।’

‘তুমি যখন সিগারেট খেয়ে ফিরে এলে তখন বাড়ির সবাই বাড়িতেই উপস্থিত ছিল?’

নেংটি একটু ভাবিয়া বলিল‌, ‘মেসোমশাই ছাড়া আর সবাই উপস্থিত ছিল।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিল‌, তারপর বলিল‌, ‘আর একটা কথা। হেনার চিঠিপত্র আসতো। কিনা জানো?’

নেংটি দৃঢ়স্বরে বলিল‌, ‘আসতো না। সকাল বিকেল যখনই চিঠি আসে‌, আমি পিওনের হাত থেকে চিঠি নিই। হেনার নামে একটাও চিঠি আজ পর্যন্ত আসেনি।’

বাইরের কারুর সঙ্গে হেনার কোন যোগাযোগ ছিল না?’

নেংটি মাথা নাড়িতে গিয়া থামিয়া গেল‌, তারপর কুঞ্চিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কী?’

নেংটি বলিল‌, ‘কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম‌, ব্যোমকেশদা। তুচ্ছ কথা বলেই বোধহয় মনে ছিল না—‘

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হোক তুচ্ছ‌, বলে শুনি।’

নেংটি ধীরে ধীরে ভাবিয়া ভাবিয়া বলিতে আরম্ভ করিল‌, ‘হেনা আসবার দশ-বারো দিন পর থেকেই ব্যাপারটা আরম্ভ হয়। আমাদের রাস্তায় বেশি গাড়ি-মোটরের চলাচল নেই‌, নির্জন বড়মানুষের পাড়া। একদিন বিকেলবেলা একটা ট্যাক্সি আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেল‌, তার ভেতরে একটা লোক বসে মাউথ-অগনি বাজাচ্ছে। মাউথ-অগনি জানেন তো। চশমার খাপের মত দেখতে‌, ঠোঁটের ওপর ঘষলে প্যাপপো পাপপো করে বাজে-খুব জোর আওয়াজ হয়—‘

0 Shares