মগ্নমৈনাক

‘জানি। তারপর বলে।’

ট্যাক্সি চলে গেল‌, দুতিন মিনিট পরে আবার উল্টে দিক থেকে মাউথ-অগনি বাজাতে বাজাতে বাড়ির সামনে দিয়ে গেল। এই ঘটনার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে হেনা ঘরে তালা লাগিয়ে বেরুলো। আমি প্রথমবার যোগাযোগটা বুঝতে পারিনি—’

‘যে লোকটা মাউথ-অগনি বাজাচ্ছিল তাকে দেখেছিলে?’

‘দেখেছিলাম। কোট-প্যান্ট-পরা একটা লোক।’

‘তারপর!’

‘তারপর দশ-বারো দিন চুপচাপ‌, হেনা বাড়ি থেকে বেরুলো না। একদিন আমি দোতলার বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার ভেতর থেকে মাউথ-অগনি বেজে উঠলো‌, আবার বাড়ি পার হয়েই থেমে গেল। কিছুক্ষণ পরে ট্যাক্সি ফিরে এল‌, বাড়ির সামনে আর একবার প্যাপপো পাপপো বাজিয়ে চলে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম‌, কী ব্যাপার‌, আমাদের বাড়ির সামনেই মাউথ-অগনি বাজায় কেন? এমন সময় দেখি‌, হেনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেদিকে ট্যাক্সি গেছে। সেই দিকে চলে গেল। হঠাৎ বুঝতে পারলাম‌, কেউ হেনাকে ইশারা করে যায়‌, অমনি হেনা তার সঙ্গে দেখা করতে বেরোয়।’

‘‘হেনা কখন ফিরে আসতো?’

‘ঘণ্টাখানেক পরেই ফিরে আসতো।’

‘কোথায় যায় তুমি জানো?’

‘কি করে জানব? একবার হেনার পিছু নিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে শাখানেক গজ দূরে রাস্তার ধারে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে ছিল‌, হেনা টুক করে তাতে উঠে পড়ল‌, ট্যাক্সি চলে গেল।’

‘হুঁ। শেষবার কবে হেনা বেরিয়েছিল?’

‘দশ-বারো দিন আগে। —আচ্ছা ব্যোমকেশদা‌, আজ তাহলে আমি পালাই‌, বডড দেরি হয়ে গেল। সুবিধে পেলেই আবার আসব।’

‘আচ্ছা‌, এস।’

নেংটি চলিয়া যাইবার পর ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। অবশেষে আমি নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বলিলাম‌, ‘কি বুঝছ?’

ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল‌, ‘মাউথ-অগানের ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে‌, কিন্তু একটা জিনিস বোঝা যায়। হেনা কলকাতা শহরে নেহাৎ একলা ছিল না! যাহোক‌, হেনার মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চয় হওয়া গেল; অপঘাত মৃত্যু নয়‌, তাকে কেউ খুন করেছে। এখন প্রশ্ন–মগ্নমৈনাকটি কে?’

বলিলাম‌, ‘ঘরে যে আগুন লাগিয়েছিল সে-ই নিশ্চয়।’

কথাটা ব্যোমকেশের মনঃপূত হইল না‌, সে মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘হতে পারে‌, আবার না-ও হতে পারে। ব্যাপারটা বুঝে দেখ। একটা লোক হেনাকে খুন করেছে‌, তার মোটিভ আমরা জানি না। যৌন-ঈর্ষা হতে পারে‌, আবার অন্য কিছুও হতে পারে। কিন্তু যে-লোকটা ঘরে আগুন দিয়েছে তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে; হেনার ঘরে এমন একটা মারাত্মক জিনিস আছে যা সে নষ্ট করে ফেলতে চায়। আমরা ঘরটা একবার মোটামুটি রকম তল্লাশ করেছি‌, কিন্তু মারাত্মক কিছু পাইনি। আবার তল্লাশ করে যদি মারাত্মক বস্তুটি খুঁজে পাই! অতএব পুড়িয়ে শেষ করে দাও।’

‘কী মারাত্মক জিনিস হতে পারে?’

‘হয়তো কাগজ‌, এক টুকরো কাগজ। বড় জিনিস হলে আমরা খুঁজে পেতাম।’

হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল‌, বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, সেই গোলাপী কাগজের টুকরো! তাতে কি লেখা আছে?’

ব্যোমকেশ দেরাজ হইতে কাগজের টুকরাটি বাহির করিয়া দিল‌, বলিল‌, ‘কবিতা। পড়ে দেখ দেখি‌, কাব্য হয়েছে কি না।’

কবিতা পড়িলাম–

তোমার হাসির ঝিলিকটুকু

ছুরির মত রইল বিঁধে বুকে

বিনা দোষে শাস্তি দিতে

পারে তোমার ঠোঁটদুটি টুকটুকে।

বলিলাম‌, মন্দ নয়‌, অনেকটা সংস্কৃত উদ্ভট কবিতার মত। কে লিখেছে?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওদের বাড়িতে কবি একজনই আছে-যুগল।’

অপরাহ্নে এ কে রে স্বয়ং জবানবন্দীর নকল লইয়া আসিলেন।

আজ তাঁহার চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের সঙ্গে ফষ্টি-নিষ্টি করিলেন‌, দুই চারিটা মজাদার গল্প বলিলেন‌, ব্যোমকেশ যে পুলিসে যোগ না দিয়া শূন্যোদরে বন্যমহিষ তাড়াইয়া বেড়াইতেছে তাহা প্রমাণ করিলেন‌, সময়োচিত পানাহার গ্রহণ করিলেন; তারপর কাজের কথায় উপস্থিত হইলেন। জবানবন্দীর ফাইল ব্যোমকেশকে দিয়া বলিলেন‌, ‘এই নাও‌, পড়ে দেখতে পার। কিন্তু তোমার কোন কাজে লাগবে না।’

ভু তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কাজে লাগবে না কেন?

এ কে রে বলিলেন‌, ‘পুলিস-দপ্তরের মতে হেনীর মৃত্যু অপঘাত ছাড়া আর কিছু নয়‌, তদন্ত চালানো নিরর্থক।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আগুন লাগার খবর পেয়েছ?’

এ কে রে বলিলেন‌, ‘পেয়েছি। ওটা সমাপতন। ইচ্ছে করে কেউ আগুন লাগিয়েছিল তার কোন প্রমাণ নেই।’

ব্যোমকেশ একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল। শেষে বলিল‌, ‘তাহলে সন্তোষবাবু আমাকে যে কাজ দিয়েছিলেন‌, সেটা গেল। তাঁর পরিবারিক স্বার্থরক্ষার আর দরকার নেই।’

এ কে রে হাসিয়া বলিলেন‌, ‘না। তুমি তাঁকে আশ্বাস দিতে পোর পুলিস তাঁর পরিবারের ওপর আর কোনো জুলুম করবে না। —ভাল কথা‌, আগুন লাগার খবর পেয়ে আমি সন্তোষবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তিনি উপস্থিত ছিলেন। কাল হেনার দেরাজের মধ্যে যে ফটোগ্রাফ পাওয়া গিয়েছিল‌, সেটা তাঁকে দেখলাম। তিনি বললেন‌, ওটা হেনার মায়ের ছবি।’

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল‌, বলিল‌, ‘ময়না তদন্তে কী পেলে?’

এ কে রে বলিলেন‌, ‘এ রকম অবস্থায় যা আশা করা যায়। তার বেশি কিছু নয়। পাঁজরার একটা হাড় ভেঙ্গে হৃৎপিণ্ডকে ফুটো করে দিয়েছে‌, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে। অন্য কোন জটিলতা নেই।’

‘মৃত্যুর সময়?’

‘সাড়ে পাঁচটা থেকে ছাঁটার মধ্যে।’

তারপর এ কে রে দু’ একটা হাসি-তামাশার কথা বলিয়া ব্যোমকেশের পিঠ চাপড়াইয়া প্রস্থান করিলেন। ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিল।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘এ কে রে কি খুব বুদ্ধিমান লোক?’

0 Shares