মগ্নমৈনাক

ব্যোমকেশ আমার পানে চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘ওর বুদ্ধি কারুর চেয়ে কম নয়।’

বলিলাম‌, ‘দোষের মধ্যে পুলিস।’

‘হ্যাঁ, দোষের মধ্যে পুলিস।’ ব্যোমকেশ জবানবন্দীর ফাইলটা তুলিয়া লইল।

আধঘণ্টা পরে জবানবন্দী পাঠ শেষ করিয়া সে ফাইল আমাকে দিল‌, বলিল‌, ‘বিশেষ কিছু নেই‌, দেখতে পারো।–আমি একটু ঘুরে আসি।’

‘কোথায় যাচ্ছ?

‘অনেক দিন দোকানে যাওয়া হয়নি‌, যাই দেখে আসি প্রভাত কি করছে।’

সে চলিয়া গেল। আমি ফাইল খুলিয়া জবানবন্দী পড়িতে আরম্ভ করিলাম—

রবীন্দ্রনাথ বর্মণ। বয়স ৩৯। সন্তোষ সমাদ্দারের অন্যতম সেক্রেটারি। সন্তোষবাবুর বাড়িতে থাকেন। বেতন ৩৫০ টাকা।

আজ শনিবার। কত অফিস থেকে চলে যাবার পর আমি আন্দাজ সাড়ে তিনটের সময় ফিরে আসি। হেনা তখন কোথায় ছিল আমি লক্ষ্য করিনি। সম্ভবত নিজের ঘরেই ছিল।

আমি কিছুক্ষণ নিজের ঘরে বিশ্রাম করলাম। সাড়ে চারটের সময় চাকর চা-জলখাবার এনে দিল‌, আমি খেলাম। তারপর পাঁচটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরুলাম। বাজারে কিছু কেনাকাটা করবার ছিল‌, সাবান টুথপেস্ট দাড়ি কামাবার ব্লেড অ্যাসপিরিন‌, এই সব।

আমি যখন বেরুই‌, তখন হল-ঘরে কেবল একজন মানুষ ছিল-উদয়। তার সঙ্গে আমার কোন কথা হয়নি‌, সে কিছুই করছিল না‌, বুকে হাত বেঁধে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। উদয় কলেজে পড়ে। বইকি‌, তবে যখন ইচ্ছে চলে আসে‌, পড়াশুনোয় মন নেই।

আমি বাজার করে ফিরলাম ছাঁটার সময়। তখনো অন্ধকার হয়নি‌, আমি নিজের ঘরে জিনিসপত্র রেখে পুবদিকের গোলাপ-বাগানে গেলাম। সেখানে কিছুক্ষণ বেড়াবার পর হঠাৎ নজরে পড়ল বাড়ির কোলে মানুষের চেহারার মত কি যেন একটা পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি-হেনা।

চেঁচামেচি করে লোক ডাকলাম। চাকরেরা ছুটে এল‌, যুগল আর উদয়ও এল-হ্যাঁ‌, ওরা দু’জনেই বাড়িতে ছিল। সবাই মিলে ধরাধরি করে লাশ বাড়িতে নিয়ে এলাম‌, তারপর পুলিসকে ফোন করলাম। না‌, কর্তা বাড়িতে ছিলেন না। শনিবার-রবিবার তিনি বাড়িতে থাকেন না। কোথায় থাকেন আমি জানি না।

যুগলচাঁদ সমাদ্দার। বয়স ২০। সন্তোষ সমাদ্দারের পুত্র।

আমি কলেজে পড়ি। আজ দুটোর পর ক্লাস ছিল না‌, তাই তিনটের সময় বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। আমার ঘর দোতলায়‌, রবিবর্মার ঘরের ওপরে।

ঘরে এসে একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম‌, তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল একেবারে সাড়ে পাঁচটার সময়ে। তাড়াতাড়ি উঠে নীচে নেমে গেলাম। না‌, হল-ঘরে কেউ ছিল না। আমি গোলাপ-বাগানে গিয়ে কিছুক্ষণ বেড়ালাম‌, তারপর ফিরে এসে দোতলায় গেলাম। চিংড়ি আমাকে চা-জলখাবার এনে দিল‌, আমি খেলাম। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে লেখাপড়া করতে বসলাম।

বাগানে আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না‌, পনেরো-কুড়ি মিনিট ছিলাম। ধরুন‌, সাড়ে পাঁচটা থেকে পৌঁনে ছটা পর্যন্ত। না‌, রব্বিমাকে বাগানে দেখিনি। বাড়ির পাশে হেনার মৃতদেহ দেখিনি। ছাঁটার পর নীচে চেঁচামেচি শুনে আমি নেমে এলাম। ওরা তখন হেনার মৃতদেহ বাড়ির মধ্যে নিয়ে আসছে।

আমার সঙ্গে হেনার ঘনিষ্ঠতা ছিল না‌, কারুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল না। সে কারুর সঙ্গে মিশতো না।

উদয়চাঁদ সমাদ্দার। বয়স ২০। সন্তোষ সমাদ্দারের পুত্র।

আজ আমি কলেজে যাইনি। দুপুরবেলা বিলিয়ার্ড খেলতে ক্লাবে গিয়েছিলাম। ক্লাবের নাম গ্রেট ইস্টার্ন স্পোর্টিং ক্লাব।

সাড়ে চারটের সময় আমি বাড়ি ফিরেছি। দোতলায় হেনার ঘরের ওপর আমার ঘর। আমি নিজের ঘরে গেলাম‌, কাপড়-চোপড় বদলে নীচের হল-ঘরে নেমে এলাম। কেন নেমে এলাম তার কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নই। আমার বাড়ি‌, আমি যখন যেখানে ইচ্ছা থাকি।

প্রশ্ন : আপনি যতক্ষণ হল-ঘরে ছিলেন‌, সেই সময়ের মধ্যে অন্য কাউকে হল-ঘরে দেখেছিলেন?

উত্তর: রবিবর্মা নিজের ঘরে ছিল‌, মাঝে মাঝে হল-ঘরে আসছিল। সে আন্দাজ পাঁচটার সময় বেরিয়ে গেল।

প্রশ্ন: আর কেউ?

উত্তর : নেংটি ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছিল‌, আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিয়ে বাইরে চলে গেল।

প্রশ্ন : হেনা তখন কোথায় ছিল?

উত্তর: নিজের ঘরে।

প্রশ্ন : আপনি হল-ঘরে থাকতে থাকতেই হেনা ছাদে যাবার জন্যে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছিল?

উত্তর : হ্যাঁ।

প্রশ্ন : তার হাতে কিছু ছিল?

উত্তর; একটা ছোট মাদুর ছিল। ভ্যানিটি-ব্যাগ ছিল।

প্রশ্ন : আপনি তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন?

উত্তর : নো কমেন্ট।

প্রশ্ন : হেনা চলে যাবার পর আপনি হল-ঘরে কতক্ষণ ছিলেন?

উত্তর: পাঁচ মিনিট।

প্রশ্ন : তারপর কোথায় গেলেন?

উত্তর: নিজের ঘরে।

প্রশ্ন : হেনার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল?

উত্তর : নো কমেন্ট।

শ্ৰীমতী চামেলি সমাদ্দার। বয়স ৪৪। সন্তোষ সমাদ্দারের স্ত্রী।

ছ’মাস আগে হেনা মল্লিক। আমার বাড়িতে এসেছিল। তার সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ ছিল না‌, তাকে কখনো দোতলায় উঠতে বলিনি। আমি মুখ দেখে মানুষ চিনতে পারি‌, হেনা ভাল মেয়ে ছিল না। আমার স্বামী কেন তাকে বাড়িতে এনেছিলেন। আমি জানি না। আমি বিরক্ত : হয়েছিলাম। কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম‌, আমি কী করতে পারি। হেনাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়নি‌, কোন কথাই হয়নি।

আমার দুই ছেলেই ভাল ছেলে‌, সচ্চরিত্র ছেলে। হেনার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না‌, উটুকো মেয়ের সঙ্গে তারা মেলামেশা করে না।

আজ পাঁচটা থেকে ছাঁটার মধ্যে আমি চিংড়ির চুল বেঁধে দিয়েছিলুম‌, চিংড়ি আমার চুল বেঁধে দিয়েছিল‌, তারপর আমি বাথরুমে গা ধুতে গিয়েছিলুম! হেনাকে তেতলার ছাদে যেতে দেখিনি‌, ছাদের ওপর কোন শব্দ শুনিনি।

শেফালিকা‌, ওরফে চিংড়ি। বয়স ১৫। সন্তোষবাবুর গৃহে পালিত। দু’বছর আগে আমাদের মা-বাবা মারা যান। সেই থেকে দাদা আর আমি মাসিমার কাছে আছি।

0 Shares