মগ্নমৈনাক

হেন যখন এ-বাড়িতে এসেছিল‌, তখন তাকে দেখে আমার খুব ভাল লেগেছিল। এত সুন্দর মেয়ে আমি দেখিনি। আমি একবার গিয়েছিলুম ভাব করতে‌, কিন্তু সে আমার মুখের ওপর দোর বন্ধ করে দিল। সেই থেকে আমি আর ওর কাছে। যাইনি‌, মাসিমা মানা করে দিয়েছিলেন। ওকে দু-একবার মেসোমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি। মেসোমশাইয়ের সঙ্গে ও ভালভাবে কথা বলত। দশ-বারো দিন অন্তর ভাল কাপড়-চোপড় পরে বাইরে যেত। কোথায় যেত। জানি না। একলা যেত‌, আবার ঘন্টাখানেক পরে ফিরে আসত। হ্যাঁ‌, রোজ সন্ধ্যার সময় হেনা ছাদে যেত‌, সেখানে একলা কি করত। জানি না; বোধহয় পায়চারি করত‌, কিংবা মাদুর পেতে বসে থাকত। মাসিমার বিশ্বাস‌, হেনা ছাদে গিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেত।

আমি স্কুলে পড়ি না‌, মাসিম আমাকে স্কুলে পড়তে দেননি। তিনি বলেন‌, স্কুল-কলেজে পড়লে মেয়েরা বিগড়ে যায়‌, সিগারেট খেতে শেখে। আমি মাসিমার কাছে ঘর-কান্নার কাজ শিখেছি।

আজ বিকেলবেলা মাসিম আমার চুল বেঁধে দিলেন‌, আমি মাসিমার চুল বেঁধে দিলুম; তারপর মাসিম বাথরুমে গেলেন। আমি দাদাদের জলখাবার দিতে গেলুম। যুগলদা নিজের ঘরে ছিলেন‌, তাঁকে খাবার দিয়ে উদয়দা’র ঘরে গেলুম। উদয়ন্দা ঘরে ছিলেন না; তাঁর টেবিলে খাবার রেখে আমি চলে এলুম। তারপর আমিও বাথরুমে গা ধুতে গেলুম। দোতলায় পাঁচটা বাথরুম আছে।

না‌, হেনা কখন ছাদে গিয়েছিল। আমি জানতে পারিনি। ছাদের ওপর শব্দ শুনিনি। বাথরুম থেকে বেরুবার পর নীচের তলা থেকে চেঁচামেচি শুনতে পেলুম‌, জানতে পারলুম হেনা ছাদ থেকে পড়ে মরে গেছে।

নির্মলচন্দ্র দত্ত, ওরফে নেংটি। বয়স ১৭। সন্তোষবাবুর গৃহে পালিত।

চিংড়ি আমার বোন। আমরা মা-বাবার মৃত্যুর পর থেকে মাসিমার কাছে আছি। আমি লেখা পড়া করি না। মেসোমশাই বলেছেন‌, আমার আঠারো বছর বয়স হলে তিনি তাঁর কোম্পানিতে চাকরি দেবেন।

হেনা দেখতে খুব সুন্দর ছিল‌, কিন্তু ভারি অহংকারী ছিল‌, আমার সঙ্গে কথাই বলত না। বাড়িতে কেবল মেসোমশাইয়ের সঙ্গে হেসে কথা বলত‌, যুগলদা আর উদয়দা’র সঙ্গে দুটো-একটা কথা বলত। হেনা সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।

আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। তখন হেনা নিজের ঘরে ছিল। ছটার পর ফিরে এসে শুনলাম সে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেছে। এর বেশি আমি আর কিছু জানি না।

জবানবন্দী পড়া শেষ করিয়া কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানিলাম। এই কয়জনের মধ্যেই কেহ হেনাকে ছাদ হইতে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়াছিল মনে হয় না। উদয় ছেলেটা একটু উদ্ধত‌, কিন্তু তাহাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। সত্যিই কি কেহ হেনাকে ছাদ হইতে ফেলিয়া দিয়াছিল? হয়তো পুলিসের অনুমানই ঠিক‌, ব্যোমকেশ ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখিতেছে। কিন্তু ঘরে আগুন লাগাও কি আকস্মিক?

নেংটি একটা লোকের কথা বলিল‌, হেনা দশ-বারো দিন অন্তর মাউথ-অগানের বাজনা শুনিয়া তাহার সহিত দেখা করিতে যাইত। লোকটা কে? সে-ই কি কোন অজ্ঞাত কারণে হেনাকে খুন করিয়াছে? সম্ভোষবাবুর তেতলার ছাদটি অবস্থা গতিকে বাহিরের লোকের পক্ষে সহজগম্য হইয়া পড়িয়াছে‌, ভারার মই বাহিয়া যে কেহ ছাদে উঠিতে পারে; অর্থাৎ‌, বাড়ির লোক এবং বাহিরের লোক সকলেরই ছাদে উঠিবার সমান সুবিধা।

সান্ধ্য চায়ের সময় হইলে ব্যোমকেশ ফিরিল। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘দোকানে কী মতলবে গিয়েছিলে?’

সে চায়ের পেয়ালায় চামচ ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল‌, ‘মতলব কিছু ছিল না। মাথার মধ্যে গুমোট জমে উঠেছিল‌, তাই একটু হাওয়া-বাতাস লাগাতে বেরিয়েছিলাম। দোকানে বিকাশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে মাঝে মাঝে প্রভাতের সঙ্গে আড্ডা দিতে দোকানে আসে।’ চায়ে একটি চুমুক দিয়া সে সিগারেট ধরাইল‌, বলিল‌, ‘বিকাশের সঙ্গে দেখা হল ভালই হল‌, তাকে কাল বিকেলে আসতে বলেছি।’

‘তাকে তোমার কী দরকার?’

‘দরকার হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে সন্তোষবাবুর ওপর। কাল সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করব। তিনি যদি আমায় বরখাস্ত করেন তাহলে আর কিছু করবার নেই।’ সে পৰ্যায়ক্রমে চা ও সিগারেটের প্রতি মনোনিবেশ করিল। আরো কয়েকটা প্রশ্ন করিয়া ভাসা-ভাসা উত্তর পাইলাম। তাহার স্বভাব জানি। তাই আর নিষ্ফল প্রশ্ন করিলাম না।

পরদিন ঠিক ন’টার সময় আমরা দুইজনে সন্তোষবাবুর অফিসে উপস্থিত হইলাম। ক্লাইভ স্ট্রীটে প্রকাণ্ড সওদাগরী সৌধ‌, তাহার দ্বিতলে সন্তোষবাবুর অফিস।

সন্তোষবাবু সবেমাত্র অফিসে আসিয়াছেন‌, এত্তেলা পাইয়া আমাদের ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমরা তাঁহার খাস কামরায় প্রবেশ করিলাম। টেবিলের উপর কাগজপত্রের ফাইল‌, দু’টি টেলিফোন‌, সন্তোষবাবু টেবিলের সামনে একাকী বসিয়া আছেন। আজ তাঁহার পরিধানে বিলাতি বেশ; কোট খুলিয়া রাখিয়াছেন; লিনেনের শার্টের সম্মুখভাগে দামী সিল্কের টাই শোভা পাইতেছে।

সন্তোষবাবু হাত নাড়িয়া আমাদের সম্ভাষণ করিলেন। আমরা টেবিলের পাশে উপবিষ্ট হইলে তিনি ভ্রূ তুলিয়া ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘কি খবর?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শুনেছেন বোধহয়‌, পুলিস সাব্যস্ত করেছে হেনার মৃত্যু সম্পূর্ণ আকস্মিক ঘটনা।’

সন্তোষবাবু চকিত হইয়া বলিলেন‌, ‘তাই নাকি! আমি শুনিনি।’ তারপর আরামের একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন‌, ‘যাক‌, বাঁচা গেল। মনে একটা অস্বস্তি লেগে ছিল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিন্তু আমি এখনো নিঃসংশয় হতে পারিনি।’

সন্তোষবাবু একটু বিস্ময়ের সহিত তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন‌, শেষে বলিলেন‌, ‘ও–মানে আপনার বিশ্বাস হেনাকে কেউ খুন করেছে?—কোন সূত্র পেয়েছেন কি?’

0 Shares