ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রথমত, ঘরে আগুন লাগাটা স্বাভাবিক মনে হয় না।’
সন্তোষবাবু শূন্য পানে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘তা বটে, ঘরে আগুন লাগাটা আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়। আর কিছু?’
ব্যোমকেশ তখন মাউথ-অগনিবাদকের কথা বলিল। সন্তোষবাবু গভীর মনোযোগের সহিত শুনিলেন, তারপর বলিলেন, ‘হুঁ। কিন্তু আমি যতদূর জানি এখানে হেনার চেনা-পরিচিত কেউ নেই।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পাকিস্তানের লোক হতে পারে। হয়তো কাজের সূত্রে দশ-বারো দিন অন্তর কলকাতায় আসতো, আর হেনার সঙ্গে দেখা করে যেত।’
এই সময় টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। সন্তোষবাবু টেলিফোন কানে দিয়া শুনিলেন, দু’বার ই হু করিলেন, তারপর যন্ত্র রাখিয়া দিলেন। ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘হতে পারে-হতে পারে। তা, আপনি এখন কি করতে চান?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার যদি অনুমতি থাকে, আমি একবার বাড়ির সকলকে জেরা করে দেখতে পারি।’
সন্তোষবাবু একটু নীরব থাকিয়া বলিলেন, ‘দেখুন ব্যোমকেশবাবু্, আপনাকে আমি আমার পারিবারিক স্বার্থরক্ষার জন্যে নিযুক্ত করেছিলাম। কিন্তু পুলিস যখন বলছে এটা দুর্ঘটনা, তখন আপনার দায়িত্র শেষ হয়েছে। অবশ্য, আপনার পারিতোষিক আপনি পাবেন–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পারিতোষিকের জন্যে আমি ব্যগ্র নই মিস্টার সমাদার, এবং বেশি কাজ দেখিয়ে বেশি পারিতোষিক আদায় করার মতলবও আমার নেই। আমি শুধু সত্য আবিষ্কার করতে চাই।’
সন্তোষবাবু ঈষৎ অধীরভাবে বলিলেন, ‘সত্য আবিষ্কার! পুলিসের হাঙ্গামা থেকে যখন রেহাই পেয়েছি, তখন নিছক সত্য আবিষ্কারে আমার আগ্রহ নেই-?
আবার টেলিফোন বাজিল। সন্তোষবাবু ফোনে কথা বলা শেষ করিতে না করিতে অন্য ফোনটা বাজিয়া উঠিল। একে একে দুইটি ফোনে কথা বলা শেষ করিয়া তিনি আমাদের পানে চাহিয়া হাসিলেন। ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘কাজের সময় আপনাকে বিরক্ত করব না। তাহলে–আপনার আগ্রহ নেই?’
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘আগ্রহ নেই, তেমনি আপত্তিও নেই। আপনি বাড়ির সকলকে জেরা করুন।’
‘ধন্যবাদ। রবিবর্মা কি অফিসে আছেন?’
‘না, তার শরীর খারাপ, সে আজ অফিসে আসেনি। বাড়িতেই আছে।’
‘আচ্ছা। আপনি দয়া করে বাড়িতে জানিয়ে দেবেন। আমরা যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা।’ তিনি টেলিফোন তুলিয়া নম্বর ঘুরাইতে লাগিলেন। আমরা চলিয়া আসিলাম।
সন্তোষবাবুর বাড়িতে পৌঁছিলাম আন্দাজ সাড়ে ন’টার সময়। দেউড়ি দিয়া প্রবেশ করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, আগে বাগানটা দেখে যাই।’
আমরা পূর্বদিকে মোড় ঘুরিলাম। বাড়ির কোণে হেনার ঘরের পোড়া কাঁচভাঙা জানালা দুটা গহ্বরের মত উন্মুক্ত হইয়া আছে। গোলাপের বাগানে সিলভার পাইনের ছায়া পড়িয়াছে, অজস্র শ্বেত-রক্ত-পীত ফুল ফুটিয়া আছে। এদিকে ভারা নাই, চুনকাম-করা দেয়াল রৌদ্র প্রতিফলিত করিতেছে। হেনা এই দেয়ালের পদমূলে পড়িয়া মরিয়াছিল, কিন্তু কোথাও কোনো চিহ্ন নাই। হত্যায় খচিত এই ধরণীর ধূলি, কিন্তু চিহ্ন থাকে না।
বাড়ির পিছন দিকে ভারা লাগানো আছে। মিস্ত্রিরা মেরামতের কাজ আরম্ভ করিয়াছে, দুইজন মজুর মাথায় লোহার কড়া লইয়া ভারা-সংলগ্ন মই দিয়া ওঠা-নামা করিতেছে। মন্থরভাবে কাজ চলিতেছে।
পিছন দিক বেড়িয়া আমরা বাড়ির পশ্চিমদিকে উপস্থিত হইলাম। এখানেও দেয়ালের গায়ে ভারা লাগানো, মিস্ত্রিরা কাজ করিতেছে, মজুর ওঠা-নমা করিতেছে। ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ঊর্ধ্বমুখ হইয়া দেখিল, তারপর মই বাহিয়া তরুতর করিয়া উপরে উঠিয়া গেল।
তিনতলার আলিসার উপর দিয়া একবার ছাদে উঁকি মারিয়া সে আবার নামিয়া আসিল। আমি উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, ‘কি ব্যাপার। ছাদে কী দেখলে?’
সে হাসিয়া বলিল, ‘ছাদে দর্শনীয় কিছু নেই। দর্শনীয় বস্তু ঐখানে।’ বলিয়া বাহিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।
ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম, খিড়কির ফটক। ব্যোমকেশ সেই দিকে অগ্রসর হইল, আমি চলিলাম। বাগানের এই দিকটাতে আম-লিচু-পেয়ারা-জামরুল প্রভৃতি ফলের গাছ; আমরা এই ফলের বাগান পার হইয়া বাড়ির বহিঃপ্রাচীরের নিকট উপস্থিত হইলাম।
খিড়কির ফটকটি সঙ্কীর্ণ লোহার শিক-যুক্ত কপট আন্দাজ পাঁচ ফুট উঁচু। তাঁহাতে তালা লাগাইবার ব্যবস্থা থাকিলেও মরিচা-ধরা অবস্থা দেখিয়া মনে হয়। বহুকাল তালা লাগানো হয় নাই। ফটকের বাহিরে একটি সরু গলি গিয়াছে। এই পথ দিয়া বাড়ির চাকর-বাকর যাতায়াত করে।
ব্যোমকেশ আমার দিকে ভ্রূ বাঁকাইয়া বলিল, ‘কি বুঝলে?’
বলিলাম, ‘এই বুঝলাম যে, বাইরে থেকে অলক্ষিতে বাগানে প্রবেশ করা যায় এবং বাগান থেকে মই বেয়ে ছাদে উঠে যাওয়াও শক্ত নয়।’
সে আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, ‘শাবাশ।-চল, এবার বাড়ির মধ্যে যাওয়া যাক।’
হল-ঘরে নেংটি হেনরি পোড়া ঘরের বাহিরে দাঁড়াইয়া সেই দিকে চাহিয়া ছিল, আমাদের দেখিয়া আগাইয়া আসিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি দেখছিলে?’
নেংটি বলিল, ‘কিছু না। আজ সকালে মাসিম এসে ঘরে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিয়েছেন। কাল থেকে মিস্ত্রি লাগবে। নতুন দোর-জানোলা বসানো হবে, ঘরের প্ল্যাস্টার তুলে ফেলে নতুন করে প্ল্যাস্টার লাগানো হবে। ভাগ্যিস আগাগোড়া কংক্রিটের বাড়ি, নইলে সারা বাড়িটাই পুড়ে ছাই হয়ে যেত। সেই সঙ্গে আমরাও।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। বাড়ির সব কোথায়?’
নেংটি বলিল, ‘বাড়িতেই আছে, মেসোমশাই ফোন করেছিলেন। দাদারা কলেজে যায়নি। ডেকে আনিব?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আমি প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে দেখা করব। রবিবর্মা কোথায়?’