মগ্নমৈনাক

‘নিজের ঘরে।’ বলিয়া নেংটি আঙুল দেখাইল।

‘আচ্ছা। তুমি তাহলে দোতলায় গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দাও। আমি রবিবর্মার সঙ্গে দেখা করেই যাচ্ছি।’

নেংটি দ্বিতলে চলিয়া গেল‌, আমরা রবিবর্মার দ্বারের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াইলাম। দ্বার ভেজানো ছিল‌, ব্যোমকেশ টোকা দিতেই খুলিয়া গেল। রবিবর্মা বলিল‌, ‘আসুন।’ তাহার গায়ে ধূসর। রঙের আলোয়ান জড়ানো‌, শীর্ণ মুখ আরও শুষ্ক দেখাইতেছে—’শরীরটা ভাল নেই‌, তাই অফিস যাইনি।’ বলিয়া কাশি চাপিবার চেষ্টা করিল।

আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরটি আয়তনে হেনার ঘরের সমতুল্য। আসবাবও অনুরূপ; একহারা খাট‌, টেবিল‌, চেয়ার‌, বইয়ের শেলফ। ঘরটি রবিবর্মা বেশ পরিচ্ছন্ন রাখিয়াছে।

ব্যোমকেশ রব্বিমাকে কিছুক্ষণ মনোনিবেশ সহকারে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘রবিবাবু্‌, তুমুপনি সত্যিই সন্তোষবাবুর নিভৃত কুঞ্জের ফোন নম্বর জানেন না?’

রবিবর্মা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘আজ্ঞে না‌, সত্যি জানি না। কর্তা  আমাকে জানাননি‌, তাই আমিও জািনবার চেষ্টা করিনি। আমি মাইনের চাকর‌, আমার কি দরকার বলুন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা বটে। সুকুমারীর নিজের বাসার ফোন নম্বর তো আপনার জানা আছে‌, সেখানেও হেনার মৃত্যুর খবর দেননি?

‘আজ্ঞে না।’

‘সে-সময় অন্য কাউকে ফোন করতে দেখেছিলেন?’

‘আজ্ঞে-গোলমালের মধ্যে সব দিকে নজর ছিল না। মনে হচ্ছে পুলিস আসবার পর নেংটি কাউকে ফোন করেছিল।’

‘নেংটি আমাকে ফোন করেছিল। সে যাক। —বলুন দেখি‌, পরশু রাত্রে যখন হেনীর ঘরে আগুন লেগেছিল‌, আপনি কিছুই জানতে পারেননি?’

রবিবর্মা কাশিতে লাগিল‌, তারপর কাশি সংবরণ করিয়া রুদ্ধ কণ্ঠে বলিল‌, ‘আজ্ঞে না‌, আমি জানতে পারিনি।’

‘আশ্চর্য।’

‘আজ্ঞে আশ্চর্য নয়‌, আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলাম। আমার মাঝে মাঝে অনিদ্ৰা হয়‌, সারা রাত জেগে থাকি। শনিবার ওই সব ব্যাপারের পর ভাবলাম ঘুম আসবে না। তাই শোবার সময় আসপিরিনের বড়ি খেয়েছিলাম। তারপর রাত্রে কী হয়েছে কিছু জানতে পারিনি।‘

ব্যোমকেশ এদিক-ওদিক চাহিল। টেবিলের উপর একটা শিশি রাখা ছিল‌, তুলিয়া দেখিল-অ্যাসপিরিনের শিশি; প্রায় ভরা অবস্থায় আছে। শিশি রাখিয়া দিয়া সে একথোলো চাবি তুলিয়া লইল। অনেকগুলি চাবি একটি রিংয়ে গ্রথিত‌, ওজনে ভারী। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এগুলো কোথাকার চাবি?’

‘অফিসের চাবি।’ রবিবর্মা চাবির গোছা ব্যোমকেশের হাত হইতে লইয়া নিজের পকেটে রাখিল–’অফিসের বেশির ভাগ দেরাজ-আলমারির চাবি আমার কাছে থাকে।’

ব্যোমকেশ সহসা প্রশ্ন করিল‌, ‘রবিবাবু্‌, আপনার দেশ কোথায়?’

থতমত খাইয়া রবিবর্মা বলিল‌, ‘দেশ? কুমিল্লা জেলায়।’

‘হেনাকে আগে থাকতে চিনতেন?’

রবিবর্মার তির্যক চোখে শঙ্কার ছায়া পড়িল‌, সে কাশির উপক্রম দমন করিয়া বলিল‌, ‘আজ্ঞে না।’

‘তার বাপ কমল মল্লিককে চিনতেন না?’

‘অ্যাঞ্জে না।’

‘হেনার মৃত্যু সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না?’ রবিবর্মা একটু ইতস্তত করিল‌, গলা বাড়াইয়া একবার হল-ঘরের দিকে উঁকি মারিল‌, তারপর চুপিচুপি বলিল‌, ‘কাউকে বলবেন না‌, একটা কথা আমি জানি।’

‘কি জানেন বলুন?’

‘সেদিন হেনার ঘরে দেখেছিলাম হেনা উলের জামা বুনছিল। কার জন্যে জামা বুনছিল জানেন? উদায়ের জন্যে।’

‘উদয়ের জন্যে! আপনি কি করে জানলেন?’

‘একদিন বিকেলবেলা আমি দেখে ফেলেছিলাম। উদয় এক বাণ্ডিল উল এনে হেনাকে দিচ্ছে। হেনা সেই উল দিয়ে সোয়েটার তৈরি করছিল।’

‘উদয়ের সঙ্গে তাহলে হেনার ঘনিষ্ঠতা ছিল?’ রবিবর্মা সশঙ্ক চক্ষে চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আর যুগলের সঙ্গে?’

‘আমি জানি না। ব্যোমকেশবাবু্‌, আমি যে আপনাকে কিছু বলেছি‌, তা যেন আর কেউ জানতে না পারে। বৌদি জানতে পারলে—’

বৌদি‌, অর্থাৎ‌, শ্ৰীমতী চামেলি। সকলেই তাঁহার ভয়ে আড়ষ্ট। মনে পড়িল‌, সে-রাত্ৰে সিঁড়ি দিয়া নামিবার সময় তাঁহার চাপা কণ্ঠস্বর শুনিয়াছিলাম‌, তুমি চুপ করে থাকবে‌, কোন কথা বলবে না।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার সঙ্গে হেনার ঘনিষ্ঠতা ছিল না?’

রবিবর্মা চমকিয়া উঠিল‌, ‘আমার সঙ্গে–আমি সারা জীবন মেয়েলোককে এড়িয়ে চলেছি। ওসব রোগ আমার নেই‌, ব্যোমকেশবাবু।’

‘ভাল। চল অজিত‌, ওপরে যাওয়া যাক।।’

দোতলায় যুগলের ঘরের উন্মুক্ত দ্বারের সম্মুখে গিয়া একটি নিভৃত দৃশ্য দেখিয়া ফেলিলাম। যুগল টেবিলের সামনে বসিয়া আছে‌, হাতে কলম‌, সম্মুখে খাতা‌, চিংড়ি চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া তাহার গলা জড়াইয়া কানে কানে ফিসফিস করিয়া কি বলিতেছে। আমাদের দেখিয়া সে ত্রস্তা হরিণীর মত চাহিল‌, তারপর আমাদের পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল।

যুগল ঈষৎ লজ্জিতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘আসুন।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘আপনাকে দুতিনটে প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেব‌, তারপর আপনি যদি কলেজে যেতে চান যেতে পারেন।’

যুগল ঘড়ি দেখিয়া বলিল‌, ‘দেরি হয়ে গেছে‌, সকালের দিকেই ক্লাস ছিল।’ সে টেবিলের নিকট হইতে সরিয়া আসিয়া খাটের পাশে বসিল‌, ‘কি জানতে চান বলুন? তাহার কথা বলিবার ভঙ্গীতে ধীর নম্রতা প্রকাশ পাইল। সে-রক্রির সেই বাজাহত বিভ্ৰান্তির ভাব আর নাই।

ব্যোমকেশ তাহারপাশে বসিয়া বলিল‌, ‘আপনি কবিতা লেখেন?’

যুগল অপ্রতিভ হইয়া পড়িল‌, ক্ষীণস্বরে বলিল‌, ‘মাঝে মাঝে লিখি।’

ব্যোমকেশ পকেট হইতে এক টুকরা গোলাপী কাগজ লইয়া যুগলের সম্মুখে ধরিল‌, বলিল‌, ‘দেখুন তো‌, এটা কি আপনার লেখা?

দেখিলাম যুগলের সুশ্ৰী মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিতেছে। সে কাগজের টুকরা লইয়া সংশয়িত চিত্তে নাড়াচাড়া করিতেছে, আমি ইত্যবসরে টেবিলের উপর হইতে খাতা লইয়া চোখ বুলাইলাম। কবিতার খাতা‌, তাহাতে চতুষ্পদী জাতীয় কয়েকটি ক্ষুদ্র কবিতা লেখা রহিয়াছে। সবগুলিই অনুরাগের কবিতা‌, তার মধ্যে একটি মন্দ লাগিল না–

0 Shares