মগ্নমৈনাক

গোলাপ‌, তোমারে ধরিনু বুকের মাঝে

বিনিময়ে তুমি কাঁটায় ছিড়িলে বুক

রক্ত আমার দরদর ঝরিয়াছে

সেই শোণিমায় রাঙা করে নাও মুখ।

এখানে গোলাপ কে তাহা অনুমান করিতে কষ্ট হয় না।

ওদিকে যুগল দু’বার গলা খাঁকারি দিয়া বলিল‌, ‘হ্যাঁ, আমারই লেখা।’

ব্যোমকেশ কণ্ঠস্বরে সমবেদনা ভরিয়া বলিল‌, ‘হেনার সঙ্গে আপনার ভালবাসা হয়েছিল।’

যুগল কিয়াৎকোল নতমুখে বসিয়া রহিল‌, তারপর মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘ভালবাসা-কি জানি। হেন যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন একটা নেশায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল–তারপর এখন—’

ব্যোমকেশ প্রফুল্লম্বরে বলিল‌, ‘নেশা কেটে যাচ্ছে। বেশ বেশ। জানালা দিয়ে গোলাপফুল আপনিই ফেলেছিলেন?’

‘হ্যাঁ।‘

‘হেনা তখন ঘরে ছিল না?’

‘না।‘

‘যুগলবাবু্‌, সে-রত্রে আপনার ভাই উদয়বাবু অভিযোগ করেছিলেন যে‌, আপনি হেনাকে মেরেছেন। এ অভিযোগের কারণ কি?’

যুগল ধীরে ধীরে বলিল‌, ‘কারণ-ঈর্ষা।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাহলে উদয়বাবুও কোর প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ।‘

সেই অতি পুরাতন নিশুম্ভ ও মোহিনীর কাহিনী। ভাগ্যক্রমে কাহিনীর উপসংহার ভিন্নপ্রকার দাঁড়াইয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনাদের দু’জনের মধ্যে হেনা কাকে বেশি পছন্দ করত?’

যুগল ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিল‌, ‘এখন মনে হচ্ছে হেনা কাউকেই পছন্দ করত না।’

‘আপনারা দুভাই ছাড়া আর কেউ হেনার প্রতি আসক্ত হয়েছিল? যেমন ধরুন—রবিবর্মা?’

যুগল চকিতে মুখ তুলিল। তাহার মুখে অবিশ্বাসের ভাব ফুটিয়া উঠিল।

সে বলিল‌, ‘রবিবর্মা! কি জানি‌, বলতে পারি না।’

উদয় নিজের ঘরে বসিয়া টেনিস র‍্যাকেটের তাঁতে তেল লাগাইতেছিল‌, আমরা দ্বারের কাছে উপস্থিত হইতেই সে ঘন ভুরুর নীচে রূঢ় চক্ষু রাঙাইয়া বলিল‌, ‘আবার কি চাই?’

ব্যোমকেশের মুখ কঠিন হইয়া উঠিল‌, সে তর্জনী তুলিয়া বলিল‌, ‘তুমি হেনাকে উল এনে দিয়েছিলে তোমার সোয়েটার বুনে দেবার জন্যে।’

উদয় উদ্ধতস্বরে বলিল‌, ‘হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। তাতে কী প্রমাণ হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘প্রমাণ হয় তোমার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেদিন সে যখন ছাদে গেল‌, তখন তুমিও তার পিছন পিছন ছাদে গিয়েছিলে। সেখানে তার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়‌, তুমি তাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে।’

উদয় হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল‌, তাহার মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল। সে সভয়ে বলিয়া উঠিল‌, ‘না-না! আমি ছাদে যাইনি। আমি হেনার পিছন পিছন সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিলাম‌, কিন্তু ছাদে পৌঁছুবার আগেই হেনা দোরে শিকল তুলে দিয়েছিল। আমি-আমি তাকে ঠেলে ফেলে দিইনি-আমি তাকে ভালবাসতাম‌, সেও আমাকে ভালবাসতো।’

ব্যোমকেশ নিষ্ঠুরস্বরে বলিল‌, ‘হেনা আর যাকেই ভালবাসুক‌, তোমাকে ভালবাসতো না। সে তোমাকে বাঁদর-নাচ নাচাচ্ছিল। এস অজিত।’

আমরা হল-ঘরের মধ্যস্থিত গোল টেবিলের কাছে গিয়া বসিলাম। ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম‌, উদয় ক্ষণকাল আচ্ছল্লের মত দাঁড়াইয়া থাকিয়া নিঃশব্দে ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

সামনে ফিরিয়া দেখি পিছনের সারির একটি ঘর হইতে শ্ৰীমতী চামেলি বাহির হইয়া আসিতেছেন। তিনি বোধ হয়। সদ্য স্নান করিয়াছেন‌, ভিজা চুলের প্রান্ত হইতে এখনো জল ঝরিয়া পড়িতেছে‌, শাড়ির আচলটা কোনমতে মাথাকে আবৃত করিয়াছে‌, চোখে সন্দিগ্ধ উদ্বেগ। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম।

শ্ৰীমতী চামেলি তীব্র অনুচ্চস্বরে ব্যোমকেশকে বলিলেন‌, ‘কী বলছিল উদয় আপনাকে?’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মারাত্মক কিছু বলেনি‌, আপনি ভয় পাবেন না। বসুন‌, আপনার কাছে দু-একটা কথা জানিবার আছে।’

শ্ৰীমতী চামেলি বসিলেন না‌, চেয়ারে বসিলে বোধ করি দেহ অশুচি হইয়া যাইবে। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘আপনারা কেন আমাদের উত্ত্যক্ত করছেন। আপনারাই জানেন। কি জানতে চান বলুন?

দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া প্রশ্নালাপ হইল। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘আপনি আগে সন্ত্রাসবাদীদের দলে ছিলেন?’

শ্ৰীমতী চামেলি বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ, ছিলাম।’

প্রশ্ন : আপনি অহিংসায় বিশ্বাস করেন না?

উত্তর: না‌, করি না।

প্রশ্ন : বর্তমানে স্বামীর সঙ্গে আপনার সদ্ভাব নেই?

উত্তর : সে-কথা সবাই জানে।

প্রশ্ন : অসদ্ভাবের কারণ কি?

উত্তর: যথেষ্ট কারণ আছে।

প্রশ্ন: আপনার সন্দেহ-হেনা আপনার স্বামীর উপপত্নী ছিল?

উত্তর : হ্যাঁ। আমার স্বামীর চরিত্র ভাল নয়।

এই নির্ভীক স্পষ্টবাদিতায় ব্যোমকেশ যেন ধাক্কা খাইয়া থামিয়া গেল। শেষে অন্য প্রসঙ্গ তুলিয়া বলিল‌, ‘নেংটি এবং চিংড়ি আপনার নিজের বোনপো বোনঝি?’

শ্ৰীমতী চামেলি একটু থমকিয়া গেলেন‌, তাঁহার উত্তরের উগ্রতাও একটু কমিল। তিনি বলিলেন‌, ‘না‌, ওদের মা আমার ছেলেবেলার সখী ছিল‌, তার সঙ্গে গঙ্গাজল পাতিয়েছিলুম। রক্তের সম্পর্ক নেই।’

প্রশ্ন: ওরা জানে?

উত্তর: না‌, এখনো বলিনি। সময় হলে বলব।

ব্যোমকেশ হাসিমুখে নমস্কার করিয়া বলিল‌, ‘ধন্যবাদ। আর আপনাকে উত্ত্যক্ত করব না। চললাম।’

শ্ৰীমন্ত্র চামেলি তীব্রটিতে আমাদের পানে চাহিয়া রছিলেন‌, আমরা নীচের তলায় নামিয়া নেংটি ফটক পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে আসিল। ব্যোমকেশের পানে রহস্যময় কটাক্ষপাত করিয়া বলিল‌, ‘কিছু বুঝতে পারলেন?’

ব্যোমকেশ একটু বিরক্তস্বরে বলিল‌, ‘না। তুমি বুঝতে পেরেছ নাকি?’

নেংটি বলিল‌, ‘আমার বোঝার কী দরকার। আপনি সত্যান্বেষী‌, আপনি বুঝবেন।’

ফুটপাথে আসিয়া ব্যোমকেশ ঘড়ি দেখিল–’সাড়ে দশটা। চল‌, এখনো সময় আছে‌, শ্ৰীমতী সুকুমারীকে দর্শন করে যাওয়া যাক।’

শ্ৰীমতী সুকুমারীর বাসা মধ্য কলিকাতার ভদ্রপল্লীতে‌, আমাদের বাসা হইতে বেশি দূর নয়। বাড়ির নীচের তলায় দোকানপাট‌, দ্বিতলে শ্ৰীমতী সুকুমারীর বাসস্থান।

0 Shares