সিঁড়ি দিয়া উঠিতে উঠিতে মৃদঙ্গ ও খঞ্জনির মৃদু নিক্কণ শুনিতে পাইলাম। সঙ্গে তরল বিগলিত কণ্ঠস্বর-রাধেশ্যাম, জয় রাধেশ্যাম! এটা বোধহয় সুকুমারী বৈষ্ণবীর গলা-সাধার সময়।
কড়া নাড়ার উত্তরে একটি বর্ষীয়সী স্ত্রীলোক আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। থান-পরা গোলগাল চেহারা, চোখে স্টীলের চশমা, মুখখানি জীবনের অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক। অনুমান করিলাম-সুকুমারীর ‘মাসি’ এবং ‘বিজনেস ম্যানেজার’।
একটি ক্ষুদ্র ঘরে আমাদের বসাইয়া মাসি ভিতরে গেল। আমরা জাজিমপাতা তক্তপোশের কিনারায় বসিলাম। ঘরে অন্য আসবাব নাই, কেবল দেয়ালে গৌর-নিতাইয়ের একটি যুগ্নচিত্র বুলিতেছে।
ভিতরের ঘরে যন্ত্রসঙ্গীত বন্ধ হইল। মাসি আসিয়া আমাদের ভিতরে লইয়া গেল। এটি বেশ বড় ঘর, মেঝেয় কাপেট পাতা। একজন শীর্ণকায় কঠিধারী বৈষ্ণব মৃদঙ্গ কোলে লইয়া যামিনী রায়ের ছবির ন্যায় বসিয়া ছিলেন, আমাদের দেখিয়া কঠোর চক্ষে চাহিলেন, তারপর উঠিয়া চলিয়া গেলেন। অদূরে সুকুমারী খঞ্জনি হাতে বসিয়া ছিল, নতশিরে আমাদের প্রণাম করিয়া ললিতকণ্ঠে বলিল, ‘আসুন।’
এক একজন মানুষ আছে যাহাদের যৌবনকাল অতীত হইলেও যৌবনের কুহক থাকিয়া যায়। সুকুমারীর বয়স সাঁইত্রিশ-আটত্রিশের কম নয়, কিন্তু ওই যে ইংরেজিতে যাহাকে যৌন-আবেদন বলে তাহা এখনো তাহার সবঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যামান; সাদা কথায়, তাহাকে দেখিলে পুরুষের মন অশ্লীল হইয়া ওঠে। উন্নত দীঘল দেহ, মুখখানিতে স্নিগ্ধ সরলতা মাখানো, চোখ দু’টি ঈষৎ ঢুলঢুলে। ছলাকলার কোন চেষ্টা নাই, অকপট সহজতাই যেন তাহাকে কেন্দ্ব করিয়া নিবিড় মায়াজাল বিস্তার করিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া প্রত্যয় হয়, কেবল সুকণ্ঠের জন্যই সে বিখ্যাত কীৰ্তন-গায়িকা হয় নাই, রূপ-গুণ-চরিত্র মিশিয়া যে সত্তাটি সৃষ্টি হইয়াছে তাহাই বিদগ্ধজনের চিত্ত আকর্ষণ করিয়া লইয়াছে; সে যেন মহাজন কবিদের কল্প লোকবাসিনী চিরায়মানা বৈষ্ণবী।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সন্তোষবাবু আপনার ঠিকানা দিয়েছিলেন, তাই ভাবলাম—’
সুকুমারী ব্যোমকেশের মুখের উপর মোহভরা চক্ষু রাখিয়া বলিল, উনি আপনার কথা ফোনে জানিয়েছেন।’ শুধু গানের গলা নয়, তাহার কথা বলার কণ্ঠস্বরও মধুক্ষরা।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে হেনার কথা শুনেছেন?’
সুকুমারী একটু বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ।’
‘হেনা নামে একটি মেয়েকে সন্তোষবাবু নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, একথা আপনি আগে থেকেই জানতেন?’
‘হ্যাঁ। বাপ-মা হারা বন্ধুর মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আমি জানতাম।’
ব্যোমকেশ একটু কুষ্ঠিতভাবে বলিল, ‘দেখুন, আপনার সঙ্গে সন্তোষবাবুর দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠতার কথা আমি জানি, সুতরাং আমার কাছে সঙ্কোচ করবেন না। সেদিন—অর্থাৎ শনিবার দুপুরবেলা থেকে কি কি হয়েছিল আমায় বলুন।’
সুকুমারী কিছুক্ষণ নতমুখে পায়ের নখ খুঁটিয়া বলিল, ‘আমার মনে কোন সঙ্কোচ নেই, বরং গৌরব। কিন্তু ওঁর মান ইজ্জত আছে, তাই লুকিয়ে রাখতে হয়। সেদিনের কথা শুনতে চান বলছি। ও বাড়িটাকে আমরা ছোট বাড়ি বলি। সেদিন বেলা আন্দাজ দুটোর সময় এখানকার কাজকর্ম সেরে আমি ছোট বাড়িতে গেলুম। পাঁচ দিন বাড়ি বন্ধ থাকে, ঝাড়া মোছা করতে সাড়ে তিনটে বেজে গেল। তারপর উনি এলেন।
‘এসে অফিসের কাপড়-চোপড় ছেড়ে স্নান করলেন। ছোট বাড়িতে ওঁর পাঁচ সেট জামা-কাপড় আছে, অনেক ইংরেজি বই আছে। উনি নিজের ঘরে গিয়ে বই নিয়ে বসলেন, আমি জলখাবার তৈরি করতে গেলুম। বাজারের খাবার উনি খান না।
‘ছটার সময় উনি জলখাবার খেলেন। তুতারপর গান শুনতে বসলেন। ছোট বাড়িতে সঙ্গীতের যন্ত্র কিছু নেই, আমি কেবল খঞ্জনি বাজিয়ে গান গাই। মনে আছে, সেদিন তিনটে পদ গেয়েছিলাম। একটি চণ্ডীদাসের, একটি গোবিন্দদাসের, আর একটি জগদানন্দর।
‘একটি পদ গাইতে অন্তত আধা ঘন্টা সময় লাগে। আমি জগদানন্দর ‘মঞ্জু বিকচ কুসুম-পুঞ্জ’ পদটি শেষ করে এনেছি, এমন সময় পাশের ঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। আমি উঠবার আগেই উনি গিয়ে ফোন ধরলেন। দুমিনিট পরে ফিরে এসে বললেন, ‘আমি এখনি যাচ্ছি, হেনা ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে।’
‘তিনি যে-বেশে ছিলেন সেই বেশে বেরিয়ে গেলেন।’
সুকুমারী নীরব হইলে ব্যোমকেশও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, শেষে বলিল, ‘কে টেলিফোন করেছিল। আপনি জানেন না?’
সুকুমারী বলিল, ‘না। তারপর আমি এ-বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিলাম, কিন্তু এ-বাড়ি থেকে কেউ ফোন করেনি।’
‘এ-বাড়িতে কে কে ফোন নম্বর জানে?’
‘কেবল দিদিমণি জানেন, আর কেউ না।’
‘দিদিমণি?
‘আমার অভিভাবিকা, কাজকর্ম দেখেন। তাঁকে ডাকব?’
‘ডাকুন।’
যাহাকে মাসি ভাবিয়ছিলাম। তিনিই দিদিমণি; আজকাল বোধহয় উপাধির পরিবর্তন ঘটিয়াছে। ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তরে তিনি সুকুমারীর বাক্য সমর্থন করিলেন। সেদিন তিনি টেলিফোন করেন নাই, এ-বাড়িতে তিনি ও সুকুমারী ছাড়া ছোট বাড়ির টেলিফোন নম্বর আর কেহ জানে না।
দিদিমণি প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ উঠিবার উপক্রম করিয়া বলিল, ‘আপনার সকালবেলাটা নষ্ট হল।‘
সুকুমারী হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘যদি পায়ের ধুলো দিয়েছেন, একটা গান শুনে যান। আমার তো আর কিছুই নেই।’
সাদা গলায় কেবল খঞ্জনি বাজাইয়া সুকুমারী গান করিল। বিদ্যাপতির আত্মনিবেদন-মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়।
তাহার গান পূর্বে কখনো শুনি নাই, শুনিয়া বিভোর হইয়া গেলাম। কণ্ঠের মাধুর্যে উচ্চারণের বিশুদ্ধতায়, অনুভবের সুগভীর ব্যঞ্জনায় আমার মনটাকে সে যেন কোন দুর্লভ আনন্দঘন রসলোকে উপনীত করিল। এতক্ষণ তাহার চিত্তচাঞ্চল্যকর কুহকিনী মূর্তিই দেখিয়ছিলাম, এখন তাহার শুদ্ধশান্ত তদগত তাপসী রূপ দেখিলাম।