সেদিন বাসায় ফিরিতে বেলা একটা বাজিয়া গেল।
স্নানাহার সারিয়া আমি বাহিরের ঘরে আসিয়াছি, ব্যোমকেশ তখনো আচাইতেছে, টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি গিয়া ফোন তুলিয়া লইলাম। সঙ্গে সঙ্গে নারীকণ্ঠে প্রবল বাক্যস্রোত বাহির হইয়া আসিল–’হ্যালো, ব্যোমকেশবাবু্, আমি চামেলি সমাদ্দার। দেখুন, আপনি সন্দেহ করেন আমার ছেলেরা হেনাকে খুন করেছে। ভুল-ভুল। আমার ছেলেরা বাপের মত নয়, ওরা সচ্চরিত্র ভাল ছেলে। ওরা কেন হেনাকে খুন করতে যাবে? আমি বলছি আপনাকে, কেউ হেনাকে খুন করেনি, সে নিজে ছাদ থেকে পড়ে মরেছে। নীচের দিকে উঁকি মেরে দেখছিল, তাল সামলাতে পারেনি।’
এই পর্যন্ত বলিয়া তিনি দম লইবার জন্য থামিলেন, আমি অত্যন্ত সঙ্কুচিতভাবে বলিলাম, ‘দেখুন, আমি ব্যোমকেশ নই, অজিত। ব্যোমকেশকে ডেকে দিচ্ছি।’
কিছুক্ষণ হতচকিত নীরবতা, তারপর কটু করিয়া টেলিফোন কাটিয়া গেল।
ইতিমধ্যে ব্যোমকেশ আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহাকে শ্ৰীমতী চামেলির কথা বলিলাম। সে সিগারেট ধরাইয়া পায়চারি করিতে করিতে বলিল–’মহিলাটির প্রকৃতি স্নায়ুপ্রধান। আজ আমি। তাঁর ছেলেদের যে-সব প্রশ্ন করেছি তা বোধহয় জানতে পেরেছেন, তাই ভয় হয়েছে। পুলিস যে হাত গুটিয়েছে তা জানেন না, জানলে আমাকে ফোন করতেন না।’ আমি বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, আজ তো সকলকেই নেড়েচেড়ে দেখলে। কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে?’
সে হাত তুলিয়া বলিল, ‘দাঁড়াও, আরো ভাবতে দাও।’
অপরাহ্নে বিকাশ আসিল, সঙ্গে একটি ক্ষীণকায় যুবক। বিকাশের চেহারা বা বাকভঙ্গীতে কোনো পরিবর্তন নাই; সে যুবকের দিকে তর্জনি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘এর নাম গুপীকেষ্ট, আমার শাকরেদ। যদি দরকার হয় তাই সঙ্গে এনেছি স্যার।’
এমন লোক আছে যাহাকে একবার দেখিয়া ভোলা যায় না। গুপীকেষ্ট ঠিক তাহার বিপরীত, তাহার চেহারা এতাই বৈশিষ্ট্যহীন যে হাজার বার দেখিলেও মনে থাকে না, বহুরূপী গিরগিটির মত বাতাবরণের সঙ্গে বেবাক মিশিয়া অদৃশ্য হইয়া যায়।
ব্যোমকেশ গুপীকেষ্টকে পরিদর্শন করিয়া সহাস্যে বলিল, ‘বেশ বেশ, বোসো তোমরা। দু’জনকেই দরকার হবে। আরো দু’জন পেলে ভাল হত।’
বিকাশ সোৎসাহে বলিল, ‘আরো আছে স্যার। কয়েকটা ছেলেকে টিকটিকি-তালিম দিচ্ছি। যদি পিছনে লাগার কাজ হয়, তারা পারবে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, পিছনে লাগার কাজ। চারজন লোকের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে।’
‘ব্যস, ঠিক আছে। বাবুই আর চিচিংকে লাগিয়ে দেব। ছেলেমানুষ হলেও ওরা হাঁশিয়ার আছে।’ বিকাশ ও গুপীকেষ্ট তক্তপোশের প্রান্তে বসিল, বিকাশ বলিল, ‘এবার সব কথা বলুন স্যার।‘
ব্যোমকেশ পুঁটিরামকে ডাকিয় চা-জলখাবার হুকুম করিল। তারপর মোটামুটি পরিস্থিতি বিকাশকে বুঝাইয়া দিল; চারজন লোকের উপর নজর রাখিতে হইবে; সন্তোষবাবু্, রবিবর্মা, যুগল এবং উদয়। তাহারা কোথায় যায়, কাহার সহিত কথা বলে, অগতানুগতিক কিছু করে কিনা। রোজ ব্যোমকেশকে রিপোর্ট দিবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু কোনো বিষয়ে খাটুকা লাগিলে তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট দিতে হইবে।
কাজকর্ম বুঝাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘কাল থেকে কাজ শুরু করে দাও। আজ লোকগুলোকে তোমাদের চিনিয়ে দেব। সন্তোষবাবুর অফিস থেকে ফেরার সময় হল। চা খেয়ে নাও, তারপর আমি তোমাদের নিয়ে বেরুব।’ বিকাশ বলিল, ‘আপনার যাবার কিছু দরকার নেই স্যার। সন্তোষবাবুর ঠিকানা দিন, আমরা সবাইকে চিনে নেব।’
ব্যোমকেশ ঠিকানা দিল। বিকাশ বলিল, ‘এখন বলুন স্যার, কে কার পিছনে লাগবে। আমি কার পিছনে লাগব? সন্তোষবাবু?’
ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, ‘না, তুমি লাগবে রবিবর্মার পিছনে। আর গুপীকেষ্ট লাগবে সন্তোষবাবুর পিছনে। বাকি দু’জন যেমন তেমন হলেই হল।’
‘তাই হবে স্যার।’ তাড়াতাড়ি জলযোগ সারিয়া বিকাশ ও গুপীকেষ্ট চলিয়া গেল। আমি বলিলাম, ‘সন্তোষবাবুকেও তাহলে তুমি সন্দেহ করা?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি সকলকেই সন্দেহ করি। তুমি যদি সেদিন ওখানে উপস্থিত থাকতে, তাহলে তোমাকেও সন্দেহ করতাম।’
প্রশ্ন করলাম, ‘নেংটিকে সন্দেহ কর?’
সে বলিল, ‘নেংটি যদি আমাকে খবর না দিত তাহলে তাকেও সন্দেহ করতাম।’
‘আর চিংড়িকে?
‘চিংড়িকে সন্দেহ করি। বোধহয় লক্ষ্য করেছ, বয়সে ছেলেমানুষ হলেও সে যুগলকে ভালবাসে। হেনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বিনী, সুতরাং তার মোটিভ আছে। সুযোগও প্রচুর।’
‘কোথায় সুযোগ? যদি উদয়ের কথা বিশ্বাস করা যায়, হেনা ছাদে গিয়ে দোর বন্ধ করে দিয়েছিল।’
‘চিংড়ি আগে থাকতে ছাদে গিয়ে লুকিয়েছিল। কিনা কে জানে। এ যুক্তি শ্ৰীমতী চামেলির বেলাতেও খাটে। তিনি হেনাকে সহ্য করতে পারতেন না, তিনি মনে করতেন হেনার সঙ্গে তাঁর স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক আছে।’
ব্যোমকেশের কথাগুলো কিছুক্ষণ মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিয়া বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, তুমি এই কেস সম্বন্ধে কী বুঝেছি আমায় বল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটি কথা নিঃসংশয়ে বলতে পারি—এটা দুর্ঘটনা নয়, খুন। এখন প্রশ্ন্্, কে খুন করেছে? একে একে সন্দেহভাজন লোকগুলিকে ধর। প্রথমে ধর সন্তোষবাবু। তিনি মস্ত বড় মানুষ, নামজাদা রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু তাঁর একটি দুর্বলতা আছে। মৃত বন্ধুর অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে তিনি আশ্রয় দিলেন। তাঁর এই সৎকার্যটি সম্পূর্ণ নিঃস্বর্থ দয়াদাক্ষিণ্য না হতে পুঞ্জ, কিন্তু তিনি হেনাকে খুন করবেন কেন? সুন্ন করার কোন মোটিভ নেই থাকলেও আমরা জানি না।‘