বলিলাম, ‘সুকুমারীর ব্যাপার নিয়ে হেনা তাঁকে ব্ল্যাকমেল করছিল এমন হতে পারে না কি?’
‘হেনা পাকিস্তানের মেয়ে, সুকুমারী-ঘটিত ব্যাপার তার জানার কথা নয়। তবু মনে কর সে জানত। তাহলে সন্তোষবাবু তাকে নিজের বাড়িতে ঠাঁই দিলেন কেন? আর ব্ল্যাকমেলে তাঁর ভয়ই বা কিসের! তাঁর স্ত্রী জানেন তাঁর চরিত্র ভাল নয়, ছেলেরা জানে বাপ শনিবারে-রবিবারে বাড়ি আসে না। রবিবর্মা জানে নেংটি জানে, বাড়ির সবাই জানে, সুতরাং বাইরের লোকও জানে। কিন্তু কারুর কিছু বলবার সাহস নেই, কেউ কিছু প্রমাণ করতে পারে না।–হেনাকে সন্তোষবাবু ভয় করবেন কেন?’
‘তা বটে। তাছাড়া তাঁর অ্যালিবাই আছে।’
‘শুধু তাঁর অ্যালিবাই নয়, সুকুমারীরও। দু’জনে দু’জনের অ্যালিবাই যোগাচ্ছেন। সুকুমারীকেও সন্দেহ থেকে বাদ দেওয়া যায় না, তার সুযোগ যত কমই হোক, মোটিভ যথেষ্ট ছিল। সন্তোষবাবুর কাছ থেকে সে হাজার টাকা মাইনে পায়, হয়তো কিছু ভালবাসাও আছে। হেনাকে যদি সে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিনী মনে করে তাহলে হেনাকে খুন করার মোটিভ তার আছে।’
‘তুমি সত্যিই সুকুমারীকে সন্দেহ কর?’
‘সত্যি-মিথ্যের কথা নয়, এ হচ্ছে হিসেবের কড়ি, একটি কানাকড়ি বাদ দেওয়া চলে না।’
‘তারপর?’
‘তারপর রবিবর্মা। তার সুযোগ ছিল প্রচুর, কিন্তু মোটিভ নিয়েই গণ্ডগোল। লোকটির প্রকৃতি পাঁকাল মাছের মত, ধরা-ছোঁয়া যায় না, ধরতে গেলেই পিছলে যায়। আমার মনে হয় রবিবর্মা আগে থেকে হেনাকে চিনত। হেনার প্রতি তার আকর্ষণ বিকর্ষণ দুইই ছিল। আকর্ষণ বুঝতে পারি, রবিবর্মা অবিবাহিত, হেনার মত সুন্দরী মেয়ের প্রতি সে আকৃষ্ট হবে এতে আশ্চর্য কিছু নেই। কিন্তু বিকর্ষণ কিসের জন্যে? হেনা কি তার কোন বিপজ্জনক গুপ্তকথা জানত? হেনা তাকে প্রণয়-ব্যাপারে প্রশ্বয় দেয়নি। তাই আক্রোশ? তাই কি সে উদয়কে ফাঁসাতে চায়?’
‘উদয়কে ফাঁসিতে চায়?’
‘উদয় হেনাকে উল কিনে দিয়েছিল, হেনা তার জন্যে সোয়েটার বুনছিল–একথা আমাকে বলবার দরকার ছিল না। এ থেকে মনে হয়, সে নিজের ঘাড় থেকে সন্দেহ নামিয়ে উদয়ের ঘাড়ে চাপাতে চায়।’
‘হুঁ। তারপর?’
‘তারপর উদয়। গোঁয়ার-গোবিন্দ ছেলে, কড়া মেজাজ, কিন্তু হেনার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। হেনা বোধহয় তাকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি আশকারা দিত, উদয় ভাবত হেনা তাকেই ভালবাসে। তারপর সে জানতে পারল যুগলের সঙ্গে হেনার কবিতা লেখালেখি চলছে, গোলাপফুলের আদান-প্রদান চলছে। ছাদের ওপর এই নিয়ে হেনার সঙ্গে উদয়ের ঝগড়া হল, রাগের মাথায় উদয় হেনাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিল। হয়তো তার খুন করবার ইচ্ছা ছিল না—‘
বলিলাম, ‘আর যুগল? তার কী মোটিভ ছিল?’
সে বলিল, ‘একই মোটিভ-যৌন-ঈর্ষা। যুগল শান্তশিষ্ট কবি মানুষ, কিন্তু তার প্রাণের মধ্যে কি রকম দুবার আগুন জ্বলে উঠেছিল কে বলতে পারে। সে যদি জানতে পেরে থাকে যে, হেনা উদয়ের জন্যে পশমের জামা বুনছে—‘
‘কিন্তু সে ছাদে গেল কি করে? উদয় সিঁড়ি দিয়ে হেনার পিছু পিছু গিয়েছিল।’
‘যুগল বাগানে গিয়েছিল, বাগান থেকে গোলাপফুল তুলে জানোলা দিয়ে হেনরি টেবিলে ফেলে দিয়েছিল। তারপর ভারার মই বেয়ে ছাদে উঠে যাওয়া কি তার পক্ষে খুব শক্ত?’
‘না, শক্ত নয়। কিন্তু গোলাপফুল উপহার দিয়েই তাকে খুন করল?’
‘গোলাপফুলটা হয়তো ভাঁওতা, পুলিসের চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা।’
‘বুঝলাম। আর কে বাকি রইল?’
‘শ্ৰীমতী চামেলি এবং চিংড়ি। দু’জনেরই মোটিভ আছে, দু’জনেরই সুযোগ সমান। শ্ৰীমতী চামেলি যখন বাথরুমে ছিলেন চিংড়ি তখন একলা ছিল, আবার চিংড়ি যখন বাথরুমে ছিল, শ্ৰীমতী চামেলি তখন একলা ছিলেন।’
আমি বলিলাম, ‘তাহলে দাঁড়াল কী? এই সাতজনের মধ্যে আসল দোষী কে?’
সে বলিল, ‘শুধু সাতজন নয়, আর একটি ছিপে রুস্তম আছেন যিনি মাউথ-অগনি বাজিয়ে হেনাকে ইশারা দিয়ে যেতেন।’
ঠিক তো, বংশীবদন বনমালীর কথা মনে ছিল না। প্রশ্ন করিলাম, ‘ব্যোমকেশ, ও লোকটা কে?’
ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল, ‘হিন্দু কি মুসলমান বলতে পারি না, কিন্তু পাকিস্তানী লোক সন্দেহ নেই। বোধহয় দু’জনের মধ্যে প্রণয় ছিল, লোকটা পাকিস্তান থেকে হেনাকে বই এনে দিত। প্রণয়-ঘটিত ব্যাপারে কখন কি ঘটে কিছুই বলা যায় না। প্রণয় হয়তো ক্রমশ বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, হেনার মন উদয়ের দিকে ঢলেছিল।’
‘লোকটা দশ-বারো দিন অন্তর আসত কেন?’
‘হয়তো সে প্লেনে আসত, হয়তো সে প্লেনের একজন অফিসার; দশ-বারো দিন অন্তর দমদমে নামে, হেনার সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করে যায়। সবই অবশ্য অনুমান।’
কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সে হঠাৎ উঠিয়া পাশের ঘরে গেল, শুনিতে পাইলাম কাহাকে ফোন করিতেছে। দু-তিন মিনিট পরে ফিরিয়া আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কাকে?’
সে বলিল, ‘নেংটিকে। বংশীধারী লোকটি হেনার মৃত্যুর পর আর এসেছিল। কিনা খবর নিচ্ছিলাম। নেংটি বলল, আসেনি।’
‘না আসার কি কারণ থাকতে পারে?’ ‘হয়তো হেনীর মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছে, কিংবা অসুখে পড়েছে, কিংবা মরে গেছে। কত রকম কারণ থাকতে পারে।’ হঠাৎ ব্যোমকেশ স্থিরদৃষ্টিতে আমার পানে চাহিল, অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল। দেখিলাম সে আমার দিকে চাহিয়া আছে বটে। কিন্তু আমাকে দেখিতেছে না, মনশ্চক্ষু দিয়া অভাবনীয় কিছু প্রত্যক্ষ করিতেছে। তারপর সে চাপা গলায় বলিল, ‘অজিত।’
বলিলাম, ‘কি হল?’ সে বলিল, ‘যেদিন হেনা মারা যায় সেদিনের কথা মনে আছে?’