মগ্নমৈনাক

এই চারজন ছাড়া আরো তিনটি মানুষ বাড়িতে থাকে। প্রথমত‌, নেংটি ও তাহার ছোট বোন চিংড়ি। বছর দুই আগে তাঁহাদের মাতা পিতা একসঙ্গে কলেরা রোগে মারা গিয়াছিলেন‌, নেংটি ও চিংড়ি অনাথ হইয়া পড়িয়াছিল। শ্ৰীমতী চামেলি তাঁহাদের সাক্ষাৎ মাসি নন‌, কিন্তু তিনি তাহাদের নিজের কাছে আনিয়া রাখিয়াছিলেন; সেই অবধি তাহারা এখানেই আছে। নেংটির পরিচয় আগেই দিয়াছি‌, চিংড়ি তাহার চেয়ে তিন-চার বছরের ছোট। তাহার চেহারাটি ছোটখাটো‌, মোটের উপর সুশ্ৰী; এই বয়সেই সে ভারি বুদ্ধিমতী ও গৃহকর্মনিপুণা হইয়া উঠিয়াছে। মাসিমা শুচিবাই-এর জন্য অধিকাংশ সময় কল-ঘরে থাকেন‌, চিংড়িই সংসার চালায়। যুগলচাঁদ তাহার নাম দিয়াছে কুচোচিংড়ি।

তৃতীয় যে ব্যক্তিটি বাড়িতে থাকেন তাঁহার নাম রবিবর্মা। পুরা নাম বোধকরি রবীন্দ্রনাথ বর্মণ; কিন্তু তিনি রবিবর্মা নামেই সমধিক পরিচিত। দীর্ঘ কঙ্কালসার আকৃতি; মুখের ডৌল‌, চোখের বক্রতা এবং গোঁফ-দাড়ির অপ্রতুলতা দেখিয়া ত্রিপুরা অঞ্চলের সাবেক অধিবাসী বলিয়া সন্দেহ হয়; বয়স আন্দাজ চল্লিশ। ইনি সন্তোষবাবুর একজন কর্মচারী‌, তাঁহার রাজনীতি-ঘটিত ক্রিয়াকলাপের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি। নিজের সংসার না থাকায় তিনি সন্তোষবাবুর গৃহেই থাকেন‌, বাড়ির একজন হইয়া গিয়াছেন; প্রয়োজন হইলে বাড়ির কাজকর্মও দেখাশোনা করেন।

এই সাতটি মানুষের সংসারে হঠাৎ যেদিন একটি অপরূপ সুন্দরী যুবতীর আবির্ভাব ঘটিল‌, সেদিন মৃত্যু-দেবতার মুখে যে কুটিল হাসি ফুটিয়াছিল তাহা কেহ দেখিতে পায় নাই। নেংটি প্রথম দিনই আসিয়া যুবতীর আবিভাবের খবর দিয়াছিল; তারপর যতবারই আসিয়াছে মশগুল হইয়া যুবতীর প্রসঙ্গ আলোচনা করিয়াছে‌, পরিবারের মধ্যে যে আকর্ষণ-বিকর্ষণের প্রবল আবহ সৃষ্টি হইয়াছিল তাহার বর্ণনা করিয়াছে। শুনিতে শুনিতে আমার মনে হইয়াছে নেংটিদের সংসারে একটি দুর্যোগ ঘনাইয়া আসিতেছে‌, কিন্তু তাহা যে এমন মারাত্মক আকার ধারণ করিবে তাহা কল্পনা করি নাই।

যুবতীর আবিভবের মাস ছয়েক পরের কথা। দুৰ্গাপূজা শেষ হইয়া কালীপূজার তোড়জোড় আরম্ভ হইয়াছে‌, এই সময় একদিন সন্ধ্যার পর ব্যোমকেশ আমাদের বসিবার ঘরে আলো জ্বালিয়া একমনে রামায়ণ পড়িতেছিল। রাজশেখর বসু মহাশয় মূল বাল্মীকি রামায়ণের চুল ছটিয়া দাড়ি-গোঁফ কামাইয়া তারতরে ঝরঝরে করিয়া দিয়াছেন‌, ব্যোমকেশ কর্মহীন দিবসের আলুনি প্রহরগুলি তাহারই সাহায্যে গলাধঃকরণ করিবার চেষ্টা করিতেছিল। আমি তক্তপোশে চিৎ হইয়া অলসভাবে এলোমেলো চিন্তা করিতেছিলাম। সাম্প্রতিক শারদীয়া পত্রিকায় যে কয়টি রচনা পড়িয়াছি‌, তাহা হইতে মনে হয় বাঙালী লেখক বাংলা ভাষা লিখিতে ভুলিয়া গিয়াছেন; রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা যেমন স্বাধীনতা পাইয়াছি‌, ভাষার ক্ষেত্ৰেও তেমনি-শাসনহীন অবাধ স্বৈরাচার.মানুষের মন আজ উন্মাৰ্গগামী‌, জলে-স্থলে-আকাশে সর্বত্র সে ধৃষ্টতা করিয়া বেড়াইতেছে…আজ সকালে সংবাদপত্রে দেখিলাম একটা এরোপ্লেন চাটগাঁ হইতে কলকাতা আসিতেছিল‌, বানচাল হইয়া সমুদ্রে ডুবিয়াছে. পাকিস্তান এয়ার লাইনসের প্লেন—একটি লোকও বাঁচে নাই, মৃতদেহের দীর্ঘ ফিরিস্তি বাহির হইয়াছে…আমরা আকাশচারী হইয়া উঠিয়াছি, মাটিতে আর পা পড়ে না…কবি সত্যেন দত্ত এরোপ্লেন সম্বন্ধে লিখিয়াছেন‌, ‘উদ্‌গত-পাখা জাঁদরেল পিপীলিকা’–উপমাটা ভারি চমকপ্রদ।

‘পাৰ্বতীর দাদার নাম জানো?’

তক্তপোশে উঠিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ রামায়ণ রাখিয়া সিগারেট ধরাইতেছে। বলিলাম‌, ‘পার্বতীর দাদা! কোন পার্বতী?

ব্যোমকেশ ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল‌, ‘মহাদেবের পার্বতী‌, হিমালয়-কন্যা পার্বতী।’

‘ও‌, বুঝেছি। পার্বতীর দাদা ছিল নাকি?’

‘ছিল।’ ব্যোমকেশ তর্জনি তুলিয়া বক্তৃতার ভঙ্গীতে বলিতে আরম্ভ করিল‌, ‘তার নাম মৈনাক পর্বত। সেকালে পাহাড়দের পাখনা ছিল‌, উড়ে উড়ে বেড়াতো‌, যখন ইচ্ছে নগর-জনপদ প্রভৃতি লোকালয়ের ওপর গিয়ে বসতো। নগর-জনপদের কী অবস্থা হত বুঝতেই পারছি। দেখে-শুনে দেবরাজ ইন্দ্র চটে গেলেন‌, বজ্র নিয়ে বেরুলেন। পৃথিবীর যেখানে যত পাহাড় পর্বত আছে‌, বজ্র দিয়ে সকলের পাখনা পুড়িয়ে দিলেন। কেবল হিমালয়-পুত্র মৈনাক পালানো, সেতুবন্ধ রামেশ্বরে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে রইল। সেই থেকে মৈনাক সমুদ্রের তলায় আছে‌, মাঝে মাঝে নাক বার করে‌, আবার ডুব মারে। অনেকটা ফেরারী আসামীর মত অবস্থা।’

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ইন্দ্র এত বড় দেবতা‌, তিনি মৈনাককে ধরতে পারলেন না?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ইন্দ্র দেবরাজ ছিলেন বটে‌, কিন্তু সত্যান্বেষী ছিলেন না। তাছাড়া‌, তিনি প্রচণ্ড মাতাল এবং লম্পট ছিলেন।’

প্রচণ্ড মাতাল এবং লম্পট হওয়া সত্ত্বেও ইন্দ্র দেবতাদের রাজা হইলেন কি করিয়া ভাবিতেছি‌, এমন সময় পাশের ঘরে কিড়িং কিড়িং। শব্দে টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। অনেকদিন এমন মধুর আওয়াজ শুনি নাই; মনটা নিমেষে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। নিশ্চয় কেহ বিপদে পড়িয়া ব্যোমকেশের শরণাপন্ন হইয়াছে। ব্যোমকেশ চেয়ার ছাড়িয়া উঠিবার আগেই আমি তড়াক করিয়া গিয়া ফোন ধরিলাম। বিপন্ন শরণার্থীকে দাঁড় করাইয়া রাখা ঠিক নয়।

ফোনে নেংটির গলা শুনিয়া একটু দমিয়া গিয়াছিলাম‌, তারপর তাহার বাতা শুনিয়া আবার চাঙ্গা হইয়া উঠিলাম। নেংটি বলিল‌, ‘অজিতবাবু্‌, শীগগির ব্যোমকেশদাকে নিয়ে আসুন। হেনা মল্লিক মরে গেছে।’

হেন মল্লিক‌, অর্থাৎ সেই অপূর্ব সুন্দরী যুবতী। উত্তেজিত হইয়া বলিলাম‌, ‘মরে গেছে। কী হয়েছিল?’

0 Shares