‘মনে থাকবে না কেন? সে তো পরশু!’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দুপুরবেলা তুমি খবরের কাগজ পড়ে শোনালে। একটা পাকিস্তানী প্লেন বানচাল হয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবেছে, মনে আছে? আমি মৈনাক পর্বতের গল্প বললাম—‘
‘মনে আছে বৈকি?’
‘সেদিনকার খবরের কাগজটা খুঁজে বার করতে পার?’
‘পারি।‘
পুরানো খবরের কাগজগুলো একস্থানে জমা করা হইত, মাসের শেষে পুঁটিরাম সেগুলিকে বিক্রয় করিত। আমি সেদিনের কাগজটা খুঁজিয়া আনিয়া ব্যোমকেশকে দিলাম, সে সাগ্রহে কাগজের পাতা উল্টাইয়া বিমান-বিপর্যয়ের ব্বিরণ দেখিতে লাগিল।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি দেখছ?’
সে কাগজের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল, ‘ডাকোটা প্লেন। সিঙ্গাপুর থেকে কায়রো পর্যন্ত দৌড়। অফিসার সবাই মুসলমান, কেবল একজন পাইলট ইংরেজ। যাত্ৰিদলের মধ্যে সব জাতের লোক ছিল—‘
ধীরে ধীরে কাগজ মুড়িয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ শূন্যদৃষ্টিতে কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া রহিল।
৬
অতঃপর আমাদের যে কর্মচঞ্চলতা আসিয়াছিল, তাহা যেন দমকা বাতাসের মত অকস্মাৎ শান্ত হইয়া গেল। দুদিন আর কোনো সাড়াশব্দ নাই। কেবল বিকাশ একবার টেলিফোন করিয়া জানাইল তাহারা শিকারের পিছনে লাগিয়া আছে। সন্তোষবাবু ও রবিবর্মা নিয়মিত অফিস যাইতেছেন ও বাড়ি ফিরিতেছেন; যুগল ও উদয় কলেজ যাইতেছে ও বাড়ি ফিরিতেছে; উদয় মাঝে একদিন বিকালবেলা হকি খেলিতে গিয়াছিল। উল্লেখযোগ্য অন্য কোনো খবর নাই।
তৃতীয় দিন, অথাৎ, বৃহস্পতিবারে আবার আমাদের জীবনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়া আসিল, তৈলাভাবে নিবন্ত প্রদীপ আবার ভাস্বর হইয়া উঠিল।
সকালবেলা নেংটি আসিল। তাহার ভাবভঙ্গীতে একটু অস্বস্তির লক্ষণ। ব্যোমকেশ তাহাকে একটি সিগারেট দিয়া বলিল, ‘কি খবর?’
নেংটি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না, সিগারেট ধরাইয়া কুঞ্চিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিল। তারপর বলিল, ‘ব্যোমকেশদা, আপনি কি উদয়দার পিছনে গুপ্তচর লাগিয়েছেন?’
ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিল, ‘কে বলল?’
‘উদয়দা বলল, একটা সিড়িঙ্গে ছোড়া তার পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘উদয় বুঝি খুব ঘাবড়ে গেছে?’
‘ঘাবড়াবার ছেলে উদয়ন্দা নয়, সে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে; যেন ভারি গৌরবের কথা। মাসিমা কিন্তু ভয় পেয়েছেন।’
ব্যোমকেশ চকিত হইয়া চাহিল, ‘তাই নাকি। কিন্তু তিনি ভয় পেলেন কেন?’
নেংটি মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘তা জানি না। কাল উদয়ন্দা মাসিমার কাছে বড়াই করছিল, জানো মা, আমার পিছনে পুলিস-গোয়েন্দা লেগেছে। তাই শুনে মাসিমার মুখ শুকিয়ে গেল। একেই তো ছটফট মানুষ, সেই থেকে আরো ছটফট করে বেড়াচ্ছিলেন। আজ সকালে আমাকে বললেন, তুই ব্যোমকেশবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়, তাঁর সঙ্গে কথা বলার।’
‘আমার সঙ্গে কথা বলবেন?’
‘হ্যাঁ।–ব্যোমকেশদা, কিছু হদিস পেলেন?’
ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘কিছু হদিস পেয়েছি।’
নেংটি বিস্ফারিত চক্ষে বলিল, ‘পেয়েছেন।’
‘বোধহয় পেয়েছি, কিন্তু তা এখনও বলবার মত নয়। চল, তোমার মাসিমা কি বলেন শুনে আসি। ওঠ অজিত।’
সন্তোষবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, নীচের তলার হল-ঘরে হৈ-হুল্লোড় চলিতেছে। চিংড়ি একটা তালপাতার পাখা লইয়া যুগলকে মারিতে ছুটিয়াছে, উদয় চিংড়ির লম্বা বেণী ঘোড়ার রাশের মত ধরিয়া তাহাকে নিয়ন্ত্রিত করিতেছে এবং বলিতেছে-‘হ্যাট ঘোড়া-হ্যাটু হ্যাট।’। চিংড়ি বলিতেছে, ‘কেন আমার খোঁপা খুলে দিলে?’ তিনজনেই উচ্চকণ্ঠে হাসিতেছে এবং ঘরময় ছুটাছুটি করিতেছে। তিনজনের মুখেই খুনসুড়ির উল্লাস।
আমাদের আবিভাবে রঙ্গক্রীড়া অর্ধপথে থামিয়া গেল। ক্ষণকালের জন্য তিনজনে অপ্রতিভভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর চিংড়ি লজ্জিত মুখে সিঁড়ি দিয়া উপরে পলায়ন করিল; যুগল ও উদয় অপেক্ষাকৃত মস্থর পদে তাহার অনুবতী হইল।
নেংটি আমাদের বসাইয়া মাসিমাকে খবর দিতে গেল। আমি চুপি চুপি ব্যোমকেশকে বলিলাম, ‘ভায়ে ভায়ে ভাব হয়ে গেছে দেখেছি?’
ব্যোমকেশ একটু গভীর হাসিয়া বলিল, ‘এর নাম যৌবন।’
নেংটি নামিয়া আসিয়া বলিল, ‘মাসিমা আপনাদের ওপরে ডাকছেন।’
দ্বিতলে উঠিলাম, কিন্তু হল-ঘরে কেউ নাই। এই খানিক আগে যাহারা উপরে আসিয়াছিল, তাহারা বোধকরি স্ব স্ব কক্ষে প্রবেশ করিয়াছে। নেংটি একটি ভেজানো দোরের কপাটে টোকা মারিল। ভিতর হইতে আওয়াজ হইল, ‘এস।’
নেংটি দ্বার ঠেলিয়া আমাদের ভিতরে লইয়া গেল।
ঘরটি শয়নকক্ষ হিসাবে বেশ বিস্তৃত; একপাশে জোড়া-খাট ঘরের বিস্তার খর্ব করিতে পারে নাই। খাটটিতে সম্ভবত শ্ৰীমতী চামেলি চিংড়িকে লইয়া শয়ন করেন। খাট ছাড়া ঘরে ওয়ার্ডরোব, কাপড়ের আলনা, ড্রেসিং-টেবিল, দুইটি আরাম-কেন্দারা। দেয়ালে একটি লেলিহরসনা মা-কালীর পট। দুইটি বড় বড় জানোলা দিয়া বাড়ির পিছন দিকের পাইনের সারি দেখা যাইতেছে।
ঘরে দুইটি স্ত্রীলোক। এক, শ্ৰীমতী চামেলি; তিনি স্নান করিয়া গরদের শাড়ি পরিয়াছেন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে আধুলির মত একটি সিঁদুরের ফোঁটা, মুখ গভীর, চক্ষে চাপা উত্তেজনার অস্বাভাবিক দীপ্তি। দ্বিতীয়, চিংড়ি। তাহার ক্রীড়া-চপলতা আর নাই। সে জানালার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ঘাড় বাঁকাইয়া বিস্ফারিত নেত্ৰে আমাদের পানে চাহিয়া আছে।
শ্ৰীমতী চামেলি বলিলেন, ‘নেংটি, চিংড়ি, তোরা বাইরে যা, আমি এদের সঙ্গে কথা কইব।’
চিংড়ির যাইবার ইচ্ছা ছিল না, সে শম্বুকগতিতে জানালা হইতে দ্বারের দিকে পা বাড়াইতেছিল, নেংটি গভীর ভূকুটি করিয়া মস্তক-সঞ্চালনে তাহাকে ইশারা করিল। দু’জনে ঘর হইতে বাহির হইল, নেংটি দ্বার ভেজাইয়া দিল।