শ্ৰীমতী চামেলি চেয়ার নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘আপনারা বসুন।’ তাঁহার কথা বলিবার ভঙ্গী কাটা-কাটা, যেন অত্যন্ত সতর্কভাবে কথা বলিতেছেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি বসুন।’ ঘরে দু’টি মাত্র চেয়ার ছিল, তৃতীয় ব্যক্তিকে বসিতে হইলে খাটের কিনারায় বসিতে হয়। শ্ৰীমতী চামেলি একবার খাটের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া মুখ ঈষৎ কুঞ্চিত করিলেন, বলিলেন, ‘আমি বসব না, আমার এখনো পুজো হয়নি। আপনারা বসুন।’
চেয়ারে বসিতে বসিতে ভাবিলাম, ইনি একদিন সন্ত্রাসবাদিনী ছিলেন, বন্দুক চালাইতেন; তখন নিশ্চয় শুচিবাই ছিল না। অবস্থাচক্ৰে মনের কত পরিবর্তনই না হয়।
আমরা উপবিষ্ট হইলে শ্ৰীমতী চামেলি কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন, ধীরে ধীরে গুনিয়া শুনিয়া কথা বলিতে লাগিলেন। সংসারের সাধারণ কথা, যাহা ব্যোমকেশকে শুনাইবার কোনই সার্থকতা নাই; মনে হইল তিনি ভয় পাইয়াছেন, তাই আসল কথাটা বলিবার আগে খানিকটা ভণিতা করিয়া লইতেছেন।
কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে শুনিয়া ব্যোমকেশ মুখ তুলিল, বলিল, ‘দেখুন, আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। আমি এ পরিবারের বন্ধু, সন্তোষবাবু আপনাদের সকলের স্বার্থরক্ষার জন্যে আমাকে নিযুক্ত করেছেন। হেনার মৃত্যু-সম্বন্ধে আপনার যদি কিছু জানা থাকে, আমাকে খুলে বলতে পারেন।’
শ্ৰীমতী চামেলি একটু থমকিয়া গেলেন, ব্যোমকেশকে যেন নূতন চক্ষু দিয়া নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, ‘আপনি পুলিসের দলের লোক নয়?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, পুলিসের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘কিন্তু–কিন্তু–আপনি জানেন পুলিস আমার ছেলেদের পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে।’
বুঝিলাম, শ্ৰীমতী চামেলি জানেন না যে পুলিস এ মামলা হইতে হাত গুটোইয়াছে। সন্তোষবাবুর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ, কে-ই বা তাঁহাকে বলিবে।
ব্যোমকেশ চুপ করিয়া রহিল। শ্ৰীমতী চামেলির স্বর তীব্র হইয়া উঠিল, ‘এ কি অন্যায়; আমার ছেলেরা নির্দোষ। তবু তাদের পিছনে গুপ্তচর লাগবে কেন?’
ব্যোমকেশ শান্তস্বরে বলিল, ‘তারা নির্দোষ কিনা জানতে চায় বলেই বোধহয় গুপ্তচর লেগেছে।’
‘আমি হাজার বার বলেছি আমার ছেলেরা নির্দোষ, তবু তাদের বিশ্বাস হয় না।’
‘কিন্তু ওরা নির্দোষ তা আপনিই বা জানলেন কি করে? দেখুন, কিছু মনে করবেন না, আপনি ওদের মা, আপনার পক্ষে ওদের নিদোষিতায় বিশ্বাস করা স্বাভাবিক। কিন্তু বাইরের লোকের পক্ষে তো তা নয়। তাদের চোখে সবাই সমান।’
শ্ৰীমতী চামেলির চোখে আভ্যন্তরিক জল্পনার ছায়া পড়িল, তিনি এক পা সম্মুখে আসিয়া হঠাৎ চাপা সুরে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আমি জানি হেনা কি করে মরেছে। আমি স্বচক্ষে দেখেছি।’
ব্যোমকেশ চমকিয়া চক্ষু বিস্ফারিত করিল—’স্বচক্ষে দেখেছেন।’
‘হ্যাঁ!’ শ্ৰীমতী চামেলি এক নিশ্বাসে বলিয়া গেলেন, ‘সেদিন চিংড়ি বাথরুমে যাবার পর আমি বাইরে এসে দেখলুম, হেনা তেতলার ছাদে যাচ্ছে। সকলেই জানে আমি হেনাকে সহ্য করতে পারি না, হেনাও আমাকে ভয় করে। আমি ভাবলুম, এই সুযোগে আমিও ছাদে গিয়ে যদি তাকে বেশ দু-চার কথা শুনিয়ে দিই, তাহলে সে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, আমার ছেলেরা নিরাপদ হবে।’
‘তাহলে ছেলেদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আপনি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন? যাহোক, তারপর?’
‘আমিও সিঁড়ি বেয়ে তেতলার ছাদে গেলুম। আমাকে দেখেই হেনা ভয় পেয়ে আলসের দিকে ছুটে গিয়ে আলসের গায়ে আছড়ে পড়ল। তারপর তাল সামলাতে না পেরে উলটে নীচে পড়ে গেল। আমাকে দেখে বোধহয় তার ভয় হয়েছিল যে আমি তাকে মারব।’
ব্যোমকেশ তাঁহার পানে নিষ্পলক চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘এসব কথা আগে বলেননি কেন?’
শ্ৰীমতী চামেলি মুখের একটা অধীর ভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ‘বললে কি কেউ বিশ্বাস করত? উল্টে সন্দেহ করত। আমিই হেনাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছি।’
ব্যোমকেশ একবার ঘাড় হেঁট করিয়া আবার মুখ তুলিল, ‘তা বটে। আচ্ছা, আপনি যখন সিঁড়ি দিয়ে ছাদে গেলেন তখন উদয়কে দেখেছিলেন?’
শ্ৰীমতী চামেলি ঈষৎ শঙ্কিত কণ্ঠে বলিলেন, ‘না, উদয় সেখানে ছিল না।’
‘কাউকে দেখেননি?’
না, কাউকে না।’
‘সিঁড়ির দরজা, ছাদে যাবার দরজা, নিশ্চয় খোলা ছিল?’
‘হ্যাঁ, খোলা ছিল।‘
‘আপনি যখন হেনাকে দেখলেন, তখন সে কী করছিল?’
‘ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল।’
‘তার হাতে কিছু ছিল?’
‘লক্ষ্য করিনি।‘
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘আর বোধহয় আপনার কিছু বলবার নেই। আচ্ছা, তাহলে আসি। পুলিসকে আপনার কথা বলে দেখতে পারেন।’
শ্ৰীমতী চামেলি শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন, আমরা চলিয়া আসিলাম।
বাসায় ফিরিতে বেলা দ্বিপ্রহর হইল।
শ্ৰীমতী চামেলি ছেলেদের বাঁচাইবার জন্য যে নিপুণ কল্পকথা রচনা করিয়াছিলেন, তাহা ব্যোমকেশকে আরও বিভ্রান্ত ও বিমর্ষ করিয়া তুলিয়াছিল। সে তক্তপোশের উপর লম্বা হইয়া বিক্ষুব্ধ স্বরে বলিল, ‘কিছু হচ্ছে না-কিছু হচ্ছে না, শুধু ভাঁওতা, শুধু ধাপ্পা। সবাই আমার চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা করছে।’
আমি বলিলাম, ‘তোমারই বা কিসের গরজ, ব্যোমকেশ? পুলিস হাল ছেড়ে দিয়েছে, সন্তোষবাবুরও আগ্রহ নেই। তবে তুমি কেন মিছে খেটে মরছ!’
ব্যোমকেশ ক্লিষ্ট স্বরে বলিল, ‘মুশকিল কি হয়েছে জানো? আমি সত্যান্বেষী, সত্যি কথাটা যতক্ষণ না জানতে পারছি, আমার প্রাণে শান্তি নেই। দুক্তোর! এ সময়ে যদি অন্য একটা কাজ হাতে থাকতো তাহলে হয়তো ভুলে থাকতে পারতাম।–’
এই সময় সদর দরজার সামনে পোস্টম্যান আসিয়া দাঁড়াইল।