ইন্সিওর-করা রেজিস্ট্রি খাম। প্রেরকের নাম-উড়িষ্যা রাজ্য সরকারের দপ্তর। কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম-কী ব্যাপার! ব্যোমকেশ খাম খুলিয়া একটি টাইপ-করা চিঠি বাহির করিল।
প্রিয় মহাশয়, মান্যবর মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়ের আদেশে এই পত্র লিখিতেছি। আপনি ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় সরকার ও বোম্বাই সরকারের পক্ষে যে কাজ করিয়াছেন তাহা আমাদের অবিদিত নহে।
সম্প্রতি উড়িষ্যা সরকারের দপ্তরে কিছু রহস্যময় ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে। দপ্তর হইতে মূল্যবান ও অতি গোপনীয় দলিল অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে, কিন্তু অপরাধীকে ধরা যাইতেছে না। এ বিষয়ে উড়িষ্যা সরকার আপনার সাহায্যপ্রার্থী। আপনি অবিলম্বে কটিকে আসিয়া তদন্তের ভার গ্রহণ করিলে বাধিত হইব। বিলম্বে রাষ্ট্রের ইষ্টহানির সম্ভাবনা।
আপনি কবে আসিতেছেন তার-যোগে জানাইলে উপকৃত হইব। আপনার রাহা-খরচ ইত্যাদি বাবদ ৫০০ টাকার চেক অত্রসহ পাঠানো হইল।
ধন্যবাদান্তে নিবেদন ইতি।–
ব্যোমকেশ প্রফুল্ল মুখে চিঠি ও চেক আমার হাতে দিল, বলিল, ‘সরকারী মহলে আমার খ্যাতি রাষ্ট্র হয়ে গেছে দেখছি।’
চিঠি পড়িয়া মুখ তুলিয়া দেখিলাম সে দুই হাত পিছন দিকে শৃঙ্খলিত করিয়া পায়চারি করিতেছে। বলিলাম, যা চাইছিলে তাই হল। যাবে তো?’
‘দেশের কাজ। যাব বৈকি।’
‘কবে যাবে?’
সে পদচারণে বিরতি দিয়া বলিল, ‘অজিত, তুমি খাওয়া-দাওয়া সেরে চেকটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে এস। আর কটকে একটা তার করে দাও, আমরা অবিলম্বে যাচ্ছি।’
প্রশ্ন করিলাম, ‘অবিলম্বেটা কবে?’
সে হাসিয়া বলিল, ‘আজ কালের মধ্যে।’
৭
সন্ধ্যা হয়-হয় এমন সময় বিকাশ আসিল, বলিল, ‘খবর আছে স্যার।’
বিকাশ, গুপীকেষ্ট, বাবুই ও চিচিং নামধারী চারিটি যুবক যে বোমকেশের পক্ষ হইতে টিকটিকির কাজ করিতেছে, তাহা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। মনটা অগ্রবর্তী হইয়া কটকের দিকে ছুটিয়াছিল।
তিনজনে ঘন-সন্নিবিষ্ট হইয়া তক্তপোশের উপর বসিলাম। বিকাশ বলিল, ‘চীনেম্যানটা বড় জ্বালিয়াছে স্যার।‘
‘চীনে ম্যান!’
ওই যে আপনার রবিবর্মা। নাক-মুখ-চোখ চীনেম্যানের মত; নিশ্চয় লুকিয়ে লুকিয়ে আরশোলা খায়।‘
‘বিচিত্র নয়। তারপর বল, জ্বালিয়েছে কি ভাবে?’
‘কদিন ধরে লোকটার পিছনে লেগে আছি, তা একবার কি এদিক-ওদিক যাবে! না, বাড়ি থেকে অফিস, আর অফিস থেকে বাড়ি। হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম স্যার। তারপর আজ—‘
‘আজ কী হয়েছে?’
‘অন্যদিন পাঁচটার সময় অফিস থেকে বেরোয়, আজ সাড়ে চারতের সময় বেরুলো। বাড়ির দিকে গেল না, বৌবাজারের বাসে উঠল। আমিও উঠলাম। লোকটার মনে পাপ আছে বেশ বোঝা যায়, বারবার পিছু ফিরে চাইছে। আমি ঘাপটি মেরে আছি। শেষে শিয়ালদার কাছাকাছি এসে রবিবর্মা টুক করে নেমে পড়ল। আমিও নামলাম।
‘আপনি লক্ষ্য করেছেন বোধহয় ঐখানে একটা হোটেল আছে—নাম ইন্দো-পাক হোটেল। তিনতলা বাড়ি, কিন্তু একটু ঘুপ্সি গোছের। যারা পাকিস্তান থেকে যাওয়া-আসা করে, তারাই বেশির ভাগ এই হোটেলে ওঠে। নীচের তলায় রেস্তরাঁ, মুর্গী-মটম চলছে, ওপরতলায় থাকবার ঘর। রবিবর্মা হোটেলে ঢুকে পড়ল।
‘রেস্তরাঁয় হট্টগোল চলছে, রবিবর্মা সেদিকে গেল না। পাশের একটা অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে চুপি চুপি ওপরে উঠে গেল।
‘আমিও গেলাম। সিঁড়ি যেখানে দোতলায় গিয়ে তেতলার দিকে মোড় ঘুরেছে, সেখানে সরু গলির মস্ত একটা বারান্দা, তার দু’পাশে সারি সারি ঘরের ঘর; মাথার ওপর ধোঁয়াটে একটা বাল্ব ঝুলছে। আমি সিঁড়ির মোড় থেকে উঁকি মেরে দেখলাম রবিবর্মা কোণের দিকের একটা ঘরের দরজা চাবি দিয়ে খুলছে। দরজা কিন্তু খুলল না; তখন রবিবর্মা চাবির গোছ থেকে আর একটা চাবি বেছে নিয়ে তালায় পরালো, কিন্তু তবু তালা খুলল না।
‘এই সময় তেতিলার দিক থেকে সিঁড়ির ওপর পায়ের আওয়াঙ্গ হল, দু-তিনজন ভাড়াটে নেমে আসছে। আমি তখন এমন ভাব দেখালাম যেন আমি দোতলায় থাকি, পকেট থেকে চাবি বার করতে করতে একটা ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম; রবিবর্মা চট করে চাবির গোছা পকেটে-পুরে নীচে নেমে গেল; আমিও তার দরজাটা এক নজরে দেখে নিয়ে তাঁর পিছু নিলাম।
‘তারপর রবিবর্মা সটান বাড়ি ফিরে গেল। তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি।‘
বোমকেশের চক্ষু কিছুক্ষণ অন্তর্নিমগ্ন হইয়া রহিল।
‘ইন্দো-পাক হোটেল—হেনা পাকিস্তানের মেয়ে ছিল—রবিবর্মা—‘ বিকাশের দিকে চোখ তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঘরের নম্বরটা লক্ষ্য করেছিলে?’
বিকাশ বলিল, ‘হ্যাঁ স্যার; দোরের মাথায় পেতলের নম্বর মারা ছিল—৭ নম্বর।‘
‘৭ নম্বর!’ ব্যোমকেশের চোখ ধক করিয়া জ্বলিয়া উঠিল।
‘হ্যা স্যার, ৭ নম্বর।‘
ব্যোমকেশ আবার চক্ষু মুদিয়া ধ্যানস্থ হইয়া পড়িল; আমারও মনে হইল সাত নম্বর কথাটা কোথায় যেন শুনিয়াছি, হঠাৎ স্মরণ করিতে পারিলাম না। বিকাশ চুপি চুপি আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘৭ নম্বরের কোন মাহাত্ম্য আছে নাকি স্যার?’
কোমকেশ চক্ষু খুলিল, বিকাশের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল, ‘তুমিই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কাজের লোক! কিন্তু কাজ এখনো শেষ হয়নি। তুমি ইন্দো-পার্ক হোটেলে ফিরে যাও, ৭ নম্বর ঘরের সামনে পাহা্রা দাও। আমরা আধা ঘন্টার মধ্যেই যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা স্যার।’ বিকাশ চলিয়া গেল।
ব্যোমকেশ পাশের ঘরে উঠিয়া গিয়া ফোন তুলিয়া লইল। সংযোগ স্থাপিত হইলে বলিল, ‘এ কে রে? আমি ব্যোমকেশ…একটু দরকার আছে..হেনার চাবির গোছা তোমার কাছে আছে তো?…বেশ বেশ। আমরা এখনি তোমার কাছে যাচ্ছি, চাবির গোছোটা দরকার…সাক্ষাতে বলব…তুমি যদি আমাদের সঙ্গে আসতে পারো তো ভাল হয়…বেশ বেশ, আমরা এখনি যাচ্ছি।’