মগ্নমৈনাক

ফোন রাখিয়া দিয়া সে বলিল‌, ‘চল‌, আজ রাত্রেই হেনা-রহস্যের সমাধান হবে মনে হচ্ছে।’

এতক্ষণে মনে পড়িল হেনার চাবির গোছায় একটা চাবিতে ৭ নম্বর ছাপ মারা ছিল।

এ কে রে-কে ট্যাক্সিতে তুলিয়া লইয়া আমরা আন্দাজ আটটার সময় ইন্দো-পাক হোটেলের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। পথে একবার মাত্র কথা হইল‌, এ কে রে বলিলেন‌, ‘আমি কিন্তু এখন পুলিস নই, স্রেফ তোমার বন্ধু।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই সই।‘

দোতলার সিঁড়ির মুখে বিকাশ রেলিংয়ে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, আমাদের দেখিয়া খাড়া হইল। ব্যোমকেশ চুপি চুপি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘সাত নম্বর ঘরের খবর কি?’

বিকাশ বলিল‌, ‘ভাল। আর কেউ আসেনি।’

‘হোটেলের ম্যানেজার কোথায় থাকে জানো?’

‘ঐ ঘরে!’ বিকাশ সামনের ঘরের দিকে আঙুল দেখাইল।

ব্যোমকেশ এ কে রে-র দিকে দৃষ্টি ফিরাইল : চোখে চোখে কথা হইল। এ কে রে ঘাড় নাড়িয়া ম্যানেজারের ঘরের বন্ধ দ্বারে টোকা দিলেন।

দ্বার খুলিয়া একটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি দাঁড়াইলেন। তাঁহার পিছনে আলোকিত ঘরটি দেখিতে পাইলাম‌, টেবিল-চেয়ার দিয়া সাজানো ঘর‌, ঘরে অন্য কেহ নাই‌, কেবল টেবিলের ওপর একটি বোতল শোভা পাইতেছে।

এ কে রে বলিলেন‌, ‘আপনি হোটেলের ম্যানেজার?’

ম্যানেজার ঢুলু ঢুলু চক্ষে এ কে রে-র পোশাক অবলোকন করিয়া বলিলেন‌, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আসতে আজ্ঞা হোক।’ বলিয়া তিনি আভুমি অবনত হইয়া অভিবাদন করিতে গিয়া গোঁত্তা খাইয়া পড়িয়া যাইতেছিলেন‌, এ কে রে তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিলেন। বলিলেন‌, ‘আমি পুলিসের কাজে আসিনি। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।’

ম্যানেজারের কণ্ঠ হইতে বিগলিত হাসির খিকখিক আওয়াজ নিৰ্গত হইল। এ কে রে ঘাড় ফিরাইয়া ব্যোমকেশকে চোখের ইশারা করিলেন‌, পকেট হইতে হেনার চাবির রিঙ লইয়া তাহার হাতে দিলেন‌, তারপর ঘরে প্রবেশ করিয়া দ্বার ভেজাইয়া দিলেন। আমরা তিনজন বাহিরে রহিলাম।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এবার সাত নম্বর।’

সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে সাত নম্বর ঘর। টিমটিমে বালবের আলোয় চাবি বাছিয়া লইয়া ব্যোমকেশ তালায় চাবি পরাইল। সঙ্গে সঙ্গে তালা খুলিয়া গেল। চাবিটা যে এই ঘরেরই এবং হেনার এই ঘরে যাতায়াত ছিল তাহাতে সন্দেহ রহিল না।

ঘর অন্ধকার। ঘরে পদার্পণ করিতে গিয়া মনে হইল একটা কালো হিংস্ব জন্তু ঘরের কোণে ওৎ পাতিয়া আছে‌, আমরা পা বাড়াইলেই ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িবে। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দাঁড়াও‌, দেশলাই বার করি।’

কিন্তু বিকাশ তৎপূর্বেই ঘরে প্রবেশ করিয়া দ্বারের পাশে হাতুড়াইয়া সুইচ টিপিল। দিপ করিয়া ঘরটা আলোকিত হইয়া উঠিল। আমরা ভিতরে গিয়া দ্বার ভেজাইয়া দিলাম।

ঘরের বদ্ধ বাতাসে সেঁতা-সেঁতা গন্ধ। একটি মাত্র জানালা বন্ধ। ঘরটি প্রায় নিরাভরণ; একদিকের দেওয়াল ঘেঁষিয়া একটি লোহার খাট নগ্ন অবস্থায় পড়িয়া আছে‌, অন্য দেওয়ালে একটি মধ্যমাকৃতি গোদরেজের স্টীলের আলমারি। আর কিছু নাই।

ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রথমেই স্টীলের আলমারির দিকে গিয়াছিল‌, সে চাবির রিঙ হইতে আর একটি চাবি লইয়া আলমারিতে লাগাইয়া পাক দিতেই কপাট খুলিয়া গেল। বিকাশ ও আমি ব্যোমকেশের পিছন হইতে ঝুঁকিয়া দেখিলাম–

আলমারির তিনটি থাক। নীচের দু’টি থাক খালি‌, উপরের থাকে একটি বই এবং রেক্সিনে বাঁধানো পুস্তকাকার একটি ফাইল রহিয়াছে। পিছন দিকে একটি কৃষ্ণবর্ণ বস্তু অস্পষ্টভাবে দেখা যাইতেছিল‌, ব্যোমকেশ হাত বাড়াইয়া সেটি বাহিরে আনিল। দেখা গেল সেটি একটি ভাঙা মাউথ-অর্গান।

মাউথ-অর্গানটি নাড়িয়া-চাড়িয়া ব্যোমকেশ আবার রাখিয়া দিল। তারপর বইখানি তুলিয়া লইল। জগজগে বাঁধানো কোয়াটো সাইজের বাংলা বই‌, মলাটে ফারসী লিপির অনুকরণে নাম লেখা আছে—ব্রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম। ব্যোমকেশ পাতা উল্টাইয়া দেখিল উপহার-পৃষ্ঠায় লেখা আছে—শ্ৰীমতী মীনা ‘মাতাহারি’ প্রিয়তমাসু। তিন্নিম্নে উপহর্তার নাম দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। নামটা একান্ত পরিচিত।

বইখানি আমার হাতে দিয়া ব্যোমকেশ রেক্সিন-বাঁধানো ফাইলটি হাতে লইল‌, সন্তর্পণে পাতা খুলিয়া আবার চট্ট করিয়া বন্ধ করিয়া ফেলিল। যতটুকু দেখিতে পাইলাম‌, মনে হইল কয়েকটি বাংলা হরফে লেখা চিঠি তাহার মধ্যে রহিয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল‌, এখানে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে।’ দেখিলাম‌, তাহার চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করিতেছে। ঘরের বাহিরে আসিয়া সে দরজায় তালা লাগাইল‌, বলিল‌,’এবার ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে।’

ম্যানেজারের ঘরে তখন আসর। জমিয়া উঠিয়াছে; নিঃশেষিত বোতলটি টেবিলের উপর গড়াইতেছে। এ কে রে একটি অর্ধ-পূর্ণ পাত্র হাতে লইয়া বসিয়া আছেন‌, ম্যানেজার হাত-জোড় করিয়া তাঁহাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতেছেন–’আর এক চুমুক স্যার‌, স্রেফ একটি চুমুক। আমার মাথার দিব্যি।’

আমরা প্রবেশ করিলে বোমকেশের সঙ্গে এ কে রে-র দৃষ্টি বিনিময় হইল‌, ব্যোমকেশ একটু ঘাড় নাড়িল। এ কে রে উঠিবার উপক্রম করিয়া বলিলেন‌, ‘আচ্ছা‌, আজ তাহলে–’

ম্যানেজার গদগদ হাস্য করিয়া বলিলেন‌, ‘তা কি হয়! ভদ্র মহো-মহোদয়েরা এসেছেন‌, এক চুমুক না খেয়ে যেতে পাবেন না। আমি আর এক বোতল ভাঙছি।’

তিনি আলমারির দিকে অগ্রসর হইলেন‌, ব্যোমকেশ বাধা দিয়া বলিল‌, ‘না না‌, আজ থাক‌, আর একদিন হবে। আচ্ছা ম্যানেজারবাবু্‌, আপনার ৭ নম্বর ঘরে কে থাকে বলুন দেখি?’

‘৭ নম্বর!’ ম্যানেজার কিছুক্ষণ চক্ষু মিটমিটি করিয়া বলিলেন‌, ‘ও ৭ নম্বর। একটি পাকিস্তানী ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছেন। ভারি মজার লোক! মাসে মাসে ভাড়া গোনেন‌, কিন্তু মাসের মধ্যে বড় জোর তিন দিন আসেন। আধা ঘন্টা থেকেই চলে যান। ভারি মজার লোক।’

0 Shares