মগ্নমৈনাক

‘তাঁর সঙ্গে কেউ আসে?’

ম্যানেজারের চোখে একটু ধূৰ্ততার ছায়া পড়িল‌, তিনি বলিলেন‌, ‘একটি পরী আসে।’

‘ভদ্রলোকের নাম কি?’

‘নাম!’ ম্যানেজার আকাশ-পাতাল চিন্তা করিয়া বলিলেন‌, ‘নামটা বিস্মরণ হয়ে গেছে। কিন্তু কুচ পরোয়া নেই‌, রেজিস্টারে নাম আছে।’

একটি বাঁধানো খাতা খুলিয়া তিনি বলিলেন‌, ‘ঠিক ধরেছি‌, যাবে কোথায়? এই যে ভদ্রলোকের নাম-ঢাকা পাকিস্তান ওমর শিরাজি।’ তিনি বিজয়োৎফুল্ল নেত্ৰে চাহিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওমর শিরাজি। ধন্যবাদ–অশেষ ধন্যবাদ। আজ চলি‌, আবার একদিন আসব।’

ম্যানেজারের আর একটি বোতল ভাঙিবার সনির্বন্ধ প্রস্তাব এড়াইয়া আমরা নীচে নামিলাম। ব্যোমকেশ বিকাশের পিঠ চাপড়াইয়া বলিল‌, ‘তোমাদের কাজ শেষ হয়েছে। আজ বাড়ি যাও। শীগগির একদিন এস।’

বিকাশ প্রস্থান করিল। আমরা একটা ট্যাক্সি ধরিয়া এ কে রে-র থানার দিকে চলিলাম‌, তাঁহাকে পৌঁছাইয়া দিয়া বাসায় ফিরিব।

পথে যাইতে যাইতে এ কে রে বলিলেন‌, ‘ম্যানেজার ভদ্রতার অবতার‌, একেবারে নাছোড়বান্দা ভদ্রলোক‌, আমাকে এক পেগ খাইয়ে তবে ছাড়লো। আরো খাওয়াবার তালে ছিল। —যাহোক‌, তোমার কাজ হল?’

ব্যোমকেশ চাবি তাহাকে ফেরত দিয়া বলিল‌, ‘হল। তুমি কিছু জানতে চাও না?’

এ কে রে দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িলেন‌, ‘না।’

বাসায় ফিরিয়া ব্যোমকেশ প্রথমেই ওমর খৈয়ামের কাব্য ও চিঠির ফাইল সযত্নে দেরাজের মধ্যে চাবি বন্ধ করিয়া রাখিল। আমি প্রশ্ন করিলাম‌, ‘ওমর খৈয়ামকে তো চিনি‌, ওমর শিরাজি লোকটি কে?’

পুরনো খবরের কাগজটা টেবিলের ওপরেই ছিল‌, ব্যোমকেশ তাহার পাতা খুলিয়া আমাকে দেখাইল। পাকিস্তানী বিমান-দুর্ঘটনায় মৃতের তালিকায় নাম রহিয়াছে-ওমর শিরাজি‌, ন্যাভিগেটর।

রাত্রের আহারাদি সম্পন্ন করিয়া ব্যোমকেশ চিঠির ফাইল লইয়া বসিল।

পরদিন বেলা ন’টার সময় সন্তোষবাবুর অফিসে উপস্থিত হইলাম।

সন্তোষবাবু সবেমাত্র আসিয়া অফিসে বসিয়াছেন, ব্যোমকেশকে দেখিয়া সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন‌, ‘একি! আপনি এখনো এখানে?’

ব্যোমকেশ পূর্ণদৃষ্টিতে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আপনার জন্যে ফাঁদ পাতব ভেবেছিলাম‌, তা আর দরকার হল না। হ্যাঁ ‌, উড়িষ্যা সরকারের নিমন্ত্রণ আমি পেয়েছি‌, কিন্তু এখনো যাওয়া হয়নি। বসতে পারি?’ অনুমতির অপেক্ষা না করিয়াই সে চেয়ারে বসিল। আমিও বসিলাম।

বেফাঁস কথা মুখ দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে। সন্তোষবাবুর মুখ ক্ষণকালের জন্য লাল হইয়া উঠিল। তারপর তিনি আত্মসংবরণ করিয়া বলিলেন‌, ‘উড়িষ্যা সরকার!’

ব্যোমকেশের ঠোঁটে একটু হাসি খেলিয়া গেল‌, সে বলিল‌, ‘আপনার সুপারিশে উড়িষ্যা সরকার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন; আপনার উদ্দেশ্য তো তাঁরা জানেন না। কিন্তু ও-কথা যাক। সন্তোষবাবু্‌, হেনা মল্লিককে কে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল আমি জানতে পেরেছি।’

আমি সন্তোষবাবুকে লক্ষ্য করিতেছিলাম‌, দেখিলাম তাঁহার মুখ পাঙাস হইয়া যাইতেছে‌, সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু দুটা সৰ্পচক্ষুর ন্যায় হিংস্র হইয়া উঠিতেছে। তিনি যে কিরূপ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির লোক‌, কোণঠাসা বন-বিড়ালের মত তাঁহার সম্মুখীন হওয়া যে অতিশয় বিপজ্জনক কাজ‌, তাহা নিমেষ মধ্যে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। দাঁতে দাঁত চাপিয়া তিনি বলিলেন‌, ‘কে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল?

ব্যোমকেশ সহজ সুরে বলিল‌, ‘আপনি।’

যেন কেহ তাঁহার গলা চাপিয়া ধরিয়াছে এমনি স্বরে সন্তোষবাবু বলিলেন‌, ‘প্রমাণ করতে পারেন?’

ব্যোমকেশ শান্তভাবে মাথা নাড়িল‌, ‘না। তবে আপনার মোটিভ আছে তা প্রমাণ করা যায়।’

‘তাই নাকি। আমি আপনার নামে মানহানির মোকদ্দমা করে আপনাকে জেলে পাঠাতে পারি তা জানেন?’

‘আমার নামে মোকদ্দমা করবার সাহস আপনার নেই‌, সন্তোষবাবু! আমার কাছে আস্ফালন করেও লাভ নেই। শুনুন‌, আপনি আমাকে আপনার পরিবারিক স্বার্থরক্ষার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন‌, সে কাজ আমি করেছি। যে কারণেই হোক‌, পুলিস হেনার মৃত্যুর তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে‌, আমার ও-বিষয়ে কোন কর্তব্য নেই। কিন্তু সত্য কথা জানিবার অধিকার সকলেরই আছে। আমি সত্য কথা জানতে পেরেছি।’

সন্তোষবাবু কিয়ৎকাল চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার চোখের মধ্যে কত প্রকার চিন্তা বিদ্যুতের মত খেলিয়া গেল তাহা নির্ণয় করা যায় না। শেষে তিনি বলিলেন‌, ‘কি সত্য কথা জানতে পেরেছেন আপনি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনি যা খুঁজেছিলেন‌, কিন্তু আপনি পাননি‌, যার জন্যে আপনি ঘরে আগুন দিয়েছিলেন‌, আমি তাই পেয়েছি! একখানা বই-রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম‌, আর কয়েকটা চিঠি।’

সন্তোষবাবুর রগের শিরা ফুলিয়া উঠিল। তিনি অসহায় বিষাক্ত চোখে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘কি চান আপনি? টাকা?’

ব্যোমকেশ শুষ্কস্বরে বলিল‌, ‘আমাকে ঘুষ দিতে পারেন এত টাকা আপনারও নেই‌, সম্ভোষবাবু। আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন‌, দেশদ্রোহিতা করেছেন‌, তার শাস্তি পেতে হবে।’

সন্তোষবাবু নির্বাক চাহিয়া রহিলেন‌, তাঁহার রাগের শিরা দপদপ করিতে লাগিল।

‘হেনার মা মীনার সঙ্গে আপনার প্রণয় ছিল। দেশ ভাগাভাগির সময় আপনি ঢাকায় যেতেন‌, মীনার সঙ্গে দেখা করতেন। আপনি জানতেন মীনা বিপক্ষ দলের গুপ্তচর‌, তা জেনেও আপনি নিজের দলের গুপ্তকথা তাকে বলতেন। শুধু মুখে বলেই নিশ্চিন্ত হননি‌, চিঠি লিখে নিজের দলের সমস্ত সলা-পরামর্শ তাকে জানাতেন। তার ফলে পদে পদে আমাদের হার হয়েছে‌, আমাদের প্রাপ্য ভূখণ্ড আমরা হারিয়েছি।

‘আপনার চিঠিগুলো মীনা রেখে দিয়েছিল। তারপর হঠাৎ সে মরে গেল‌, চিঠিগুলো তার মেয়ে হেনার হাতে এল। হেনার একজন দোসর ছিল-ওমর শিরাজি। দু’জনে মিলে ষড়যন্ত্র করল‌, তারপর হেনা এসে আপনার বুকে চেপে বসে ব্ল্যাকমেল শুরু করল।’

0 Shares