মগ্নমৈনাক

সন্তোষবাবুর চোখ দুটা রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল‌, তিনি হঠাৎ হাত বাড়াইয়া বলিয়া উঠিলেন‌, ‘এক লাখ টাকা দেব‌, চিঠিগুলো আমায় ফেরৎ দিন।’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল‌, সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষবাবু দাঁড়াইলেন‌, রক্তাক্ত ভীষণ চক্ষে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘দেবেন না?’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল‌, তারপর আস্তে আস্তে বলিল‌, ‘কাল থেকে একটি বিশিষ্ট দৈনিক সংবাদপত্রে আপনার চিঠিগুলির ফ্যাকসিমিলি একে একে ছাপা হবে। প্রস্তুত থাকবেন।’

সন্তোষবাবু দুই চক্ষে অগ্নি বিকীর্ণ করিতে করিতে বসিয়া পড়িলেন। ব্যোমকেশ আমাকে ইশারা করিল‌, আমরা দ্বারের দিকে চলিলাম।

পিছন হইতে ডাক আসিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু!’

আমরা ফিরিয়া গিয়া সন্তোষবাবুর সামনে দাঁড়াইলাম‌, তিনি টেবিলের উপর দুই কনুই রাখিয়া দুহাতে চোখ ঢাকিয়া বসিয়া আছেন। এক মিনিট পরে তিনি হাত নামাইলেন; দেখিলাম তাঁহার মুখ ভাবলেশহীন। তিনি বলিলেন‌, ‘আমাকে একদিন সময় দেবেন? আজ বিকেল পাঁচটার সময় পার্ক সার্কাস মাঠে আমার বক্তৃতা আছে—‘

ব্যোমকেশ তাঁহার মুখের উপর গভীর দৃষ্টি রাখিয়া ধীরস্বরে বলিল‌, ‘একদিন সময় দিলাম। কাল‌, সকালে সংবাদপত্রে আপনার চিঠি ছাপা হবে না। কিন্তু একটা কথা জানিয়ে রাখি। গুণ্ডা লাগিয়ে আমাকে খুন করালেও কোনো লাভ হবে না‌, চিঠিগুলির নাগাল আপনি পাবেন না। যথাসময়ে সেগুলি ছাপা হবে।’

‘ধন্যবাদ।’

সারাদিন ব্যোমকেশ তক্তপোশে শুইয়া কড়িকাঠ গণনা করিল‌, কথা বলিল না। বেলা চারটের সময় চা আসিলে উঠিয়া বসিয়া চা পান করিল‌, তারপর বলিল‌, ‘চল‌, বেরনো যাক।।’

‘কোথায় যাবে?

‘সন্তোষবাবুর লেকচার শুনতে।’

সুতরাং বাহির হইলাম। মাথার উপর যাহার খাঁড়া ঝুলিতেছে‌, সে কিরূপ বক্তৃতা দিবে। শুনিবার কৌতূহল বোধকরি স্বাভাবিক।

পার্ক সার্কাসের মাঠে মঞ্চ রচিত হইয়াছে‌, মঞ্চের উপর এক সারি গণ্যমান্য ব্যক্তি উপবিষ্ট‌, প্রধান সচিবও আছেন। সম্মুখে বৃহৎ জনতা। রাজনৈতিক কোনো একটা গুরুতর প্রসঙ্গ জনসাধারণের গোচর করার উদ্দেশ্যে এই সভা আহূত হইয়াছে। আমরা জনতার পিছনে গিয়া দাঁড়াইলাম।

প্রথমে প্রধানমন্ত্রী উঠিলেন‌, তিনিই সভাপতি। মাইকের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বিষয়বস্তুর অবতারণা করিলেন। তারপর একে একে বক্তারা উঠিলেন। সামান্য যুক্তিতর্কের ফোড়ন দিয়া প্রবল হৃদয়বেগপূর্ণ বক্তৃতা। মুগ্ধ হইয়া বাক্যতরঙ্গে ভাসিয়া চলিলাম।

সর্বশেষে মাইকের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন সন্তোষবাবু। তাঁহার মুখের দৃঢ় গাম্ভীর্য বিষয়বস্তুর গুরুত্র সূচনা করিতেছে। ক্ষণকাল নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া তিনি ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিলেন।

লোকটির বক্তৃতা দিবার ক্ষমতা আছে। উচ্ছ্বাস নাই‌, ভাবালুতা নাই‌, কেবল দুনিবার যুক্তির দ্বারা তিনি শ্রোতার সমগ্র মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া লইলেন। ক্রমে তাঁহার ভাষণের ছন্দ দ্রুত হইতে লাগিল‌, অন্তৰ্গঢ় আবেগে কণ্ঠস্বর মৃদঙ্গর ন্যায় ধ্বনিত হইয়া উঠিল। তারপর তিনি যখন বস্তৃক্ততার শেষে উদাত্ত কণ্ঠে বন্দে মাতরম উচ্চারণ করিলেন‌, তখন শ্রোতাদের কণ্ঠ হইতেও স্বতরুৎসারিত জয়ধ্বনি উত্থিত হইল।

ভাষণ শেষ করিয়া সন্তোষবাবু নিজ আসনে গিয়া বসিলেন।’ আমার দৃষ্টি তাঁহার উপরেই নিবদ্ধ ছিল‌, দেখিলাম। তিনি পকেট হইতে একটি কোটা বাহির করিয়া কিছু মুখে দিলেন। ভাবিলাম‌, হয়তো পেনিসিলিনের বড়ি।

ইতিমধ্যে প্রধান সচিব আসিয়া সভা সংবরণের ভাষণ আরম্ভ করিয়াছেন‌, শ্রোতারা উঠি-উঠি করিতেছে‌, এমন সময় হঠাৎ মঞ্চের উপর একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। মুহুর্তে আমার দৃষ্টি সেইদিকে ছুটিয়া গেল; দেখিলাম সন্তোষবাবু নিজ আসনে এলাইয়া পড়িয়াছেন‌, আশেপাশে যাঁহারা ছিলেন তাঁহারা উদ্বিগ্নভাবে তাঁহার দিকে ঝুকিয়া দেখিতেছেন। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ থামাইয়া সেইদিকে ছুটিয়া গেলেন। শ্রোতাদের মধ্যে একটা উত্তেজিত গুঞ্জন উঠিল।

পাঁচ মিনিট পরে প্রধানমন্ত্রী মাইকের কাছে ফিরিয়া আসিয়া আবেগপূর্ণ স্বরে বলিলেন‌, ‘মর্মান্তিক দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি‌, আমাদের প্রিয় সুহৃৎ‌, দেশের সুসন্তান সন্তোষ সমাদ্দার ইহলোক ত্যাগ করেছেন—?

তিনি ভগ্নস্বরে বলিয়া চলিলেন। ব্যোমকেশ আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইল‌, বলিল‌, ‘চল। পঞ্চমাঙ্কে যবনিকা পতন হয়েছে।’

পার্কের বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল‌, বলিল‌, ‘চল‌, হাঁটা যাক।’

পথ অনেকখানি‌, তবু ট্রামে-বাসে চড়িবার ইচ্ছা হইল না। আমিও সিগারেট ধরাইয়া বলিলাম‌, ‘চল।’

পাশাপাশি চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ বলিতে আরম্ভ করিল–

‘সন্তোষবাবু প্রতিভাবান পুরুষ ছিলেন‌, কিন্তু তিনি চরিত্রবান ছিলেন না। ইংরেজিতে কথা আছে-নাবিকদের বন্দরে বন্দরে বৌ‌, সন্তোষবাবুরও ছিল তাই। তিনি কাজের সূত্রে মাদ্রাজ বোম্বাই দিল্লী সর্বত্র ঘুরে বেড়াতেন‌, আমার বিশ্বাস প্রত্যেক শহরেই তাঁর একটি করে প্ৰেয়সী ছিল। বুড়ো বয়সেও তাঁর ও-রোগ সারেনি।

‘কলকাতাতে যেমন তাঁর ছিল সুকুমারী‌, ঢাকায় তেমনি ছিল মীনা। মীনা ধর্মে মুসলমানী ছিল। সকল দেশে সকল সভ্য সমাজেই এক শ্রেণীর স্ত্রীলোক থাকে যারা বাইরে বেশ সভ্য-ভাব্য, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিলাসিনীর ব্যবসা চালায়। পাশ্চাত্য দেশে ওদের নাম-ডেমি মনডোন। মীনা ছিল ডেমি মনডোন। তার স্বামী ছিল কিনা জানি না‌, বোধহয় সাক্ষীগোপাল গোছের একজন কেউ ছিল‌, তার নাম কমল মল্লিক। কমল মল্লিক নামটা হিন্দু নাম‌, আবার কামাল মল্লিক বললে মুসলমান নাম হয়ে যায়। হেনা মল্লিক নামটাও তাই। মল্লিক পদবী হিন্দুদের মধ্যে আছে‌, কিন্তু আসলে ওটা মুসলমানী খেতাব।

0 Shares