মগ্নমৈনাক

‘মীনার ছবি দেখেছ‌, সে ছিল অপরূপ সুন্দরী। সমাজের উঁচু মহলে তার প্রসার ছিল। সন্তোষবাবুকেও সে কুহকের নাগপাশে বেঁধে ফেলেছিল‌, যখনই তিনি ঢাকায় যেতেন। মীনার সঙ্গে তাঁর দেখা হত। সে বোধহয় তাঁকে গজল শোনাতো।

‘তারপর এল স্বাধীনতা‌, এল দেশ-ভাগাভাগির যুদ্ধ। সে যে কী নৃশংস যুদ্ধ তা কারুর ভোলবার কথা নয়। এই সময় সন্তোষবাবু আমাদের দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। দুই পক্ষের মধ্যে যখন দূতের প্রয়োজন হল‌, তখন সন্তোষবাবু আমাদের পক্ষ থেকে দৌত্যকার্যে নিযুক্ত হলেন। তিনি বারবার কলকাতা থেকে ঢাকা যাতায়াত করতে লাগলেন। স্বভাবতাই মীনার সঙ্গে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ হতে লাগিল।

সন্তোষবাবু তখন মীনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন‌, তিনি নিজের দলের অতিবড় গুপ্তকথাগুলিও মীনার কাছে প্রকাশ করে ফেলতে লাগলেন। মীনা রঙ্গিণী মেয়ে হলেও নিজের দলের স্বার্থচিস্তা তার মনে ছিল‌, সে গুপ্ত সংবাদগুলি যথাস্থানে পৌঁছে দিতে লাগল। অবস্থাটা ভেবে দেখ‌, রাজনৈতিক কূটযুদ্ধ চলছে‌, ওদের গুপ্ত অভিপ্ৰায় আমরা কিছুই জানি না‌, ওরা আমাদের গুপ্ত অভিপ্ৰায় সমস্ত জানে। ফল অনিবাৰ্য।

‘সন্তোষবাবুর তখন এমন মোহমত্ত অবস্থা যে‌, তিনি মীনাকে কেবল মৌখিক গুপ্তকথা জানিয়ে নিরস্ত হননি‌, যখন কলকাতায় থাকতেন তখন চিঠি লিখে তাকে গুপ্ত সংবাদ জানাতেন। এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণ কী আমি জানি না‌, সম্ভবত অন্য কোন দেশনেতার প্রতি ব্যক্তিগত ঈর্ষা। কিন্তু তিনি যে জেনেশুনে মীনাকে খবর পাঠাতেন‌, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম বইয়ের উপহার পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছিলেন—মীনা মাতাহারি। তিনি জানতেন মীনা বিপক্ষ দলের গুপ্তচর।

যাহোক‌, দেশ-ভাগাভাগির লড়াই একদিন শেষ হল। তারপর কয়েক বছর কেটে গেল। মীনা সন্তোষবাবুর চিঠিগুলি যত্ন করে রেখে দিয়েছিল‌, নষ্ট করেনি। তার কি মতলব ছিল বলতে পারি না‌, হয়তো ভেবেছিল কোনদিন সন্তোষবাবু যদি বাঁধন ছেঁড়বার চেষ্টা করেন তখন চিঠিগুলো কাজে লাগবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন মীনা মারা গেল। বোধহয় অ্যাকসিডেন্টেই মারা গিয়েছিল।

‘মীনার একটি মেয়ে ছিল–হেনা। মা যখন মারা গেল তখন সে সাবালিকা হয়েছে। সে মায়ের কাগজপত্রের মধ্যে সন্তোষবাবুর চিঠিগুলো খুঁজে পেল। হেনার নিশ্চয় দু-চারজন উমেদার ছিল‌, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম ওমর শিরাজি। শিরাজি বিমান কোম্পানিতে কাজ করত‌, এরোপ্লেনের ন্যাভিগেটর। দেশে দেশে উড়ে বেড়াতো‌, তার প্লেনের দৌড় সিঙ্গাপুর থেকে কায়রো। দশ-বারো দিন অন্তর তার প্লেন দমদমে নামতো।

‘হেনা ওমর শিরাজিকে চিঠির কথা বলল‌, দু’জনে পরামর্শ করল সন্তোষবাবুকে ব্ল্যাকমেল করবে। তারা কলকাতায় এসে সোজাসুজি তাদের মতলব সন্তোষবাবুকে জানালো। হেনা এসে তাঁর বাড়িতে জাঁকিয়ে বসল। ওরা ভেবে দেখেছিল সন্তোষবাবুর বাড়িই হেনার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। সন্তোষবাবু জাঁতিকালে পড়ে গেলেন। ইচ্ছে থাকলেও হেনাকে খুন করতে পারেন না‌, তাহলেই ওমর শিরাজি তাঁর গুপ্তকথা ফাঁস করে দেবে। তিনি ব্ল্যাকমেলের টাকা শুনতে লাগলেন।

মারাত্মক চিঠিগুলো হেনা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সন্তোষবাবু আবিষ্কার করতে পারেননি, তবে সন্দেহ করেছিলেন যে হেনা তাঁর বাড়িতে নিজের ঘরে চিঠিগুলো লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু নিজের বাড়ি বলেই সেখানে তল্লাশ করবার সুবিধা নেই। হেন সর্বদা নিজের ঘরে থাকে‌, কেবল সন্ধ্যেবেলা নমাজ পড়বার জন্যে একবার ছাদে যায়। তাও দোরে তালা লাগিয়ে।

‘ওমর শিরাজি ইন্দো-পাক হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল। সেই ঘরে ওদের সাক্ষী প্রমাণ যাবতীয় চিঠিপত্র ওরা লুকিয়ে রেখেছিল। বোধহয় ব্যবস্থা ছিল‌, সন্তোষবাবু হেনাকে হগুয় হগুপ্তায় টাকা দেবেন। কত টাকা দিতেন জানি না‌, সন্তোষবাবুর ব্যাঙ্কের হিসেব পরীক্ষা করলে জানা যাবে। যাহোক‌, টাকা নিয়ে হেনা ওমর শিরাজির অপেক্ষা করত। যথাসময়ে শিরাজি এসে মাউথ-অর্গান বাজিয়ে তাকে সঙ্কেত জানাতো‌, তারপর দু’জনে ইন্দো-পাক হোটেলে যেত। সেখানে হেনা শিরাজিকে টাকা দিত‌, শিরাজি টাকা নিয়ে পাকিস্তানে চলে যেত। এই ছিল তাদের মোটামুটি কর্মপদ্ধতি।’

বলিলাম, ‘ভারতীয় টাকা নিয়ে যেত?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘টাকা নিয়ে যেত‌, কিংবা সোনা কিনে নিয়ে যেত‌, কিংবা কলকাতার কোন ব্যাঙ্কে টাকা জমা রেখে যেত। আমার বিশ্বাস টাকা নিয়ে যেত।’

‘তারপর বলো।’

‘হেনা যে সন্তোষবাবুর অনাথ বন্ধু-কন্যা নয়‌, সে তাঁর রক্ত-শোষণ করছে‌, একথা কেবল একজনই সন্দেহ করেছিল। রবিবর্মা। সে সন্তোষবাবুর সেক্রেটারি‌, তার ওপর ভীষণ ধূর্ত ধড়িবাজ লোক। হেনাকে সে আগে থাকতে চিনত কিনা বলা যায় না‌, কিন্তু কোন সময় সে হেনার পিছু নিয়ে ইন্দো-পাক হোটেলের সন্ধান পেয়েছিল‌, বুঝেছিল যে ৭ নম্বর ঘরে মারাত্মক দলিল আছে। সে এক গোছা চাবি যোগাড় করে তাক বুঝে ৭ নম্বর ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দরজা খুলতে পারেনি। তার বোধহয় মতলব ছিল দলিলগুলো হস্তগত করতে পারলে সে-ই সন্তোষবাবুকে ব্ল্যাকমেল করবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি। হেনার মৃত্যুর পর সে একবার চেষ্টা করেছিল। বিকাশ তার পিছনে লেগেছিল‌, সে দেখে ফেলল। বিকাশ যদি তাকে ইন্দো-পাক হোটেলের ৭ নম্বর ঘরের সামনে দেখতে না পেত‌, তাহলে সন্তোষবাবুকে ধরা যেত না।’

আমি বলিলাম‌, ‘একটা কথা। এমন কি হতে পারে না যে‌, সন্তোষবাবুই রবিবর্মাকে নিযুক্ত করেছিলেন দলিলগুলো উদ্ধার করার জন্যে?’

0 Shares