ব্যোমকেশ বলিল, ‘না। সন্তোষবাবু এর মধ্যে থাকলে ছিঁচকে চোরের মত কাজ করতেন না। ম্যানেজারকে মোটা ঘুষ দিয়ে কার্যসিদ্ধি করতেন। যাহোক, পরের কথা আগে বলব না। সন্তোষবাবু জাঁতিকালে পড়ে যন্ত্রণা ভোগ করছেন, ছ-মাস কেটে গেছে, আরো কতদিন চলবে ঠিক নেই, এমন সময় এক ব্যাপার ঘটল। একদিন সকালবেলা খবরের কাগজ খুলে সন্তোষবাবু দেখলেন একটি পাকিস্তানী বিমান সমুদ্রে ডুবেছে, মৃতদের মধ্যে নাম পেলেন-ওমর শিরাজি।
‘ব্যাস, সন্তোষবাবু উদ্ধারের পথ দেখতে পেলেন। হেনা খবরের কাগজ পড়ে না, সে এখনো জানতে পারেনি; সে খবর পাবার আগেই তাকে শেষ করতে হবে। তিনি জানতেন, হেনা রোজ সন্ধ্যেবেলা নমাজ পড়তে ছাদে যায়। বর্তমানে বাড়ি মেরামত হচ্ছে, ভারা বেয়ে বাইরে থেকে ছাদে ওঠা সহজ। তিনি ঠিক করে ফেললেন কী করে হেনাকে মারবেন। এমনভাবে মারবেন যাতে অপঘাত মৃত্যু বলে মনে হয়।
‘দিনটা ছিল শনিবার। বিকেলবেলা তিনি সুকুমারীর কাছে গেলেন, সুকুমারীর সঙ্গে পরামর্শ করে নিজের অ্যালিবাই তৈরি করলেন। আট-ঘাট বেঁধে কাজ করতে হবে।’
আমি বলিলাম, ‘সুকুমারী যে আমাদের কাছে ডাহা মিথ্যে কথা বলেছিল তা বুঝতে পারিনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। সন্তোষবাবুর প্রতি সুকুমারীর প্রাণের টান ছিল, নইলে সে তাঁর জন্যে নিজেকে খুনের মামলায় জড়িয়ে ফেলত না। সন্তোষবাবুর মৃত্যুতে যদি কেউ দুঃখ পায় তো সে সুকুমারী।
‘খিড়কির ফটক দিয়ে সন্তোষবাবু নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলেন, ভারা বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। হেনা বোধ হয় তখন মাদুর পেতে পশ্চিমদিকে মুখ করে নামাজ পড়বার উপক্রম করছিল, দেখল সন্তোষবাবু উঠে আসছেন। তাঁর অভিপ্ৰায় বুঝতে হেনার দেরি হল না, সে ভয় পেয়ে ছাদের পুবদিকে পালাতে লাগল। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? আলসের কাছে আসতেই সন্তোষবাবু পিছন থেকে ছুটে এসে তাকে ধাক্কা দিলেন, সে ছাদ থেকে নীচে পড়ে গেল।
‘সন্তোষবাবু ছাদের শিকল খুলে দিয়ে, যেমন এসেছিলেন তেমনি ভারা বেয়ে নেমে গেলেন। শিকল খুলে দেবার কারণ—যদিও কেউ হেনার মৃত্যুকে খুন বলে সন্দেহ করে, তাহলেও আততায়ী কোন দিক থেকে ছাদে উঠেছে তা অনিশ্চিত থেকে যাবে।
‘সন্তোষবাবু বাড়িতে এসেছিলেন তা কেউ জানল না, তিনি কর্তব্যকর্ম সুসম্পন্ন করে সুকুমারীর কাছে ফিরে গেলেন। কিন্তু একটা কাজ বাকি ছিল।
‘চিঠিগুলো নিশ্চয় হেনার ঘরে আছে। পুলিস খুঁজে পায়নি বটে, কিন্তু পরে পেতে পারে। গভীর রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন তিনি চুপি চুপি নেমে এসে হেনার ঘর তল্লাশ করলেন। কিন্তু চিঠি খুঁজে পেলেন না। তখন তিনি পেট্রোল ঢেলে হেনার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলেন। ঢাকীসুদ্ধ বিসর্জন।’
ব্যোমকেশ চুপ করিল। কিছুক্ষণ নীরবে চলিবার পর জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সন্তোষবাবুকে টেলিফোন করেছিল কে?’
সে বলিল, ‘কেউ না। ওটা কপোলকল্পিত। নিভৃত নিকুঞ্জগৃহে ফিরে গিয়ে সন্তোষবাবু নিশ্চিন্ত হতে পারেননি, হেনা যদি দৈবাৎ না মরে থাকে! তাছাড়া চিঠিগুলো হেনার ঘর থেকে সরাতে হবে। তাই তিনি একটি অজ্ঞাত সংবাদদাতা সৃষ্টি করলেন; সুকুমারীকে টেলিফোন সম্বন্ধে তালিম দিয়ে বাড়িতে ফিরে এলেন।’
‘অদ্ভূত অভিনেতা কিন্তু সন্তোষবাবু।’
‘হ্যাঁ। অদ্ভুত বক্তা, অদ্ভুত অভিনেতা-এরা সব এক জাতের।’
‘আচ্ছা ব্যোমকেশ, সন্তোষবাবু তোমাকে পারিবারিক স্বার্থরক্ষার জন্যে নিযুক্ত করলেন কেন? গোড়াতেই তোমাকে বিদেয় করলেন না কেন?’
‘নেংটি একটা দুষ্কার্য করে ফেলেছিল, আমাকে ডেকেছিল। আমাকে বিদেয় করে দিলে তাঁর ওপর সকলের সন্দেহ হত, তাই তিনি সাধু সেজে আমাকে তাঁর পরিবারিক স্বার্থরক্ষার জন্যে নিযুক্ত করলেন। পরে অবশ্য ছাড়াবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তখন কমলি নেহি ছোড়তি।’
‘তুমি কখন ওঁকে সন্দেহ করলে?’
‘ঘরে আগুন লাগার খবর পেয়ে বুঝলাম কোনো দাহ্য পদার্থ পুড়িয়ে দেবার জন্যেই ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। কি রকম দাহ্য পদাৰ্থ? নিশ্চয় এমন কোনো দাহ্য পদার্থ, যা সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বভাবতাই দলিলের কথা মনে আসে। কি রকম দলিল? যার সাহায্যে ব্ল্যাকমেল করা যায়। তাহলে হেনা কাউকে ব্ল্যাকমেলা করছিল? কাকে ব্ল্যাকমেল করছিল? যুগল আর উদয়কে বাদ দেওয়া যায়; বাকি রইল রবিবর্মা এবং সন্তোষবাবু। কিন্তু রবিবর্মা সামান্য লোক, তাকে ব্ল্যাকমেল করে বেশি টাকা আদায় করা যায় না। অপর পক্ষে সন্তোষবাবু বড়লোক, তাঁর পূর্ববঙ্গে নিত্য যাতায়াত, হেনাকে তিনি নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। পুলিসের শৈথিল্যের পিছনেও হয়তো তাঁর প্রভাব কাজ করছে। আমাকে কলকাতা থেকে সরিয়ে কটকে পাঠানোর চেষ্টার পিছনেও তিনি আছেন। সুতরাং তিনিই সব দিক দিয়ে যোগ্য পাত্র।–ভাল কথা কাল সকালে কটকে একটি টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে, জানা দরকার তারা এখনো আমাকে চায় কিনা।’
‘বেশ। সন্তোষবাবুর চিঠিগুলো কি করবে?’
‘পুড়িয়ে ফেলব। ও চিঠির কাজ শেষ হয়েছে। সন্তোষবাবু প্ৰায়শ্চিত্ত করেছেন, তাঁর সুনাম নষ্ট করে কারুর লাভ নেই। মগ্নমৈনাক মগ্নই থাক।’
বাসায় ফিরিয়া দেখি নেংটি বসিয়া আছে। সত্যবতীর নিকট হইতে চা ও সিগারেট সংগ্রহ করিয়া পরম আরামে সেবন করিতেছে। সে সন্তোষবাবুর মৃত্যু-সংবাদ পায় নাই। ব্যোমকেশকে দেখিয়া ভ্রূ তুলিয়া ব্যগ্রভরে বলিল, ‘কী, এখনো হেনার খুনীকে ধরতে পারলেন না।’
ব্যোমকেশ বিরক্ত স্বরে বলিল, ‘পেরেছি। তুমি এখানে কি করছ?’