মগ্নমৈনাক

নেংটি বলিল‌, ‘তেতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মরে গেছে। পুলিস এসেছে। মেসোমশাই বাড়ি নেই-আজ শনিবার—আপনারা শীগগির আসুন।’

ব্যোমকেশ আসিয়া আমার হাত হইতে টেলিফোন লইল‌, বলিল‌, ‘কে‌, নেংটি! কী হয়েছে?’

সে কিছুক্ষণ ধরিয়া শুনিল‌, তারপর–’আচ্ছা-দেখি’–বলিয়া টেলিফোন রাখিয়া দিল। আমরা বসিবার ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। ঘড়িতে তখন সাতটা বাজিয়া পঁয়ত্ৰিশ মিনিট হইয়াছে।

ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া পায়চারি করিতে লাগিল। আমি কিছুক্ষণ তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলাম‌, যাবে কি না ভাবছ?’

সে বলিল‌, ‘যাওয়া উচিত কি না ভাবছি। গৃহস্বামী ডাকেননি‌, হয়তো ব্যাপারটা অপঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়; এ অবস্থায় নেংটির ডাক শুনে যাওয়া উচিত হবে কি?’

আমি বিবেচনা করিয়া বলিলাম‌, ‘গৃহস্বামী বাড়ি নেই। আর যারা আছে তারা ছেলেমানুষ। বাড়িতে পুলিস এসেছে। নেংটিকে হয়তো তার মাসিম আমাদের কাছে খবর পাঠাতে বলেছেন। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধু হিসেবে আমরা যদি যাই‌, খুব অন্যায় হবে কি?’

ব্যোমকেশ আরো কিছুক্ষণ ভ্রূকুটি করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘তা বটে। চল তবে বেরুনো যাক।’

সন্তোষবাবুর বাড়িতে পৌঁছিলাম সাড়ে আটটা নাগাদ। ফটকের দেউড়িতে কেহ নাই। বাড়িটা অন্ধকারে দেখা গেল না‌, কেবল বাড়ির বহিভাগে দেওয়ালের গায়ে ভারা বাঁধা হইয়াছে চোখে পড়িল। বোধহয় দেওয়ালির আগে মেরামত ও চুনকামের কাজ চলিতেছে।

বাড়িতে প্রবেশ করিলেই বড় একটি সাজানো হল-ঘর‌, মাথার উপর চার-পাঁচটা তীব্র বৈদ্যুতিক বালব ঘরটিকে দিনের মত উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে। ঘরের মাঝামাঝি স্থানে একটু নীচু গোল টেবিল‌, তাহাকে ঘিরিয়া কয়েকটা চেয়ার এবং সোফা। আমরা ঘরে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম সেখানে আট-দশ জন পুরুষ রহিয়াছেন‌, তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই ইউনিফর্ম-পরা পুলিস।

আমরা প্রবেশ করিলাম কেহ লক্ষ্য করিল না। একজন ইন্সপেক্টর টেবিলের সামনে বসিয়া নত হইয়া ডায়েরিতে কিছু লিখিতেছিলেন‌, বাকি সকলে টেবিল ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল; সকলের

তাহাদের মধ্যে নেংটিকে চিনিতে পারিলাম। বাকি তিনজনের মধ্যে একজন যে সেক্রেটারি রবিবর্মা তাহা তাহার মঙ্গোলীয় মুখ দেখিয়া সহজেই বোঝা যায়। অবশিষ্ট দুইজন অল্পবয়স্ক যুবক‌, সুতরাং নিশ্চয় যুগলচাঁদ ও উদয়চাঁদ। দু’জনের মুখেই শক-খাওয়া জবুথবু ভাব‌, এখনো প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয় নাই।

আমরা প্রবেশ করিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইলাম। ব্যোমকেশ একবার ঘরের চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল। বাঁ দিকে আসবাব কিছু নাই‌, কেবল দূরের কোণে উচু টিপয়ের উপর টেলিফোন‌, মাঝখানে গোল টেবিল ঘিরিয়া কয়েকজন লোক‌, ডান দিকে প্ৰায় দেওয়ালের কাছে সাদা কাপড়-ঢাকা একটি মূর্তি মেঝোয় পড়িয়া আছে; তাহার ওপারে দ্বিতলে উঠিবার সিঁড়ির নিম্নতম ধাপে দুইটি স্ত্রীলোক ঘেঁষাৰ্ঘেষি হইয়া বসিয়া আছে; নিশ্চয় শ্ৰীমতী চামেলি ও চিংড়ি। তাঁহাদের চোখে অবিমিশ্র বিভীষিকা; তাঁহারা চাদর-ঢাকা মৃতদেহের পানে চাহিতেছেন না‌, একদৃষ্টি ঘরের মাঝখানে সমবেত মানুষগুলির পানে চাহিয়া আছেন।

ব্যোমকেশও এক নজরে সব দেখিয়া লইয়া সেইদিকেই অগ্রসর হইল‌, টেবিলের সম্মুখস্থ হইয়া বলিয়া উঠিল‌, ‘আরো! এ কে রে!’

ইন্সপেক্টর ডায়েরি হইতে মুখ তুলিলেন; অন্য সকলে ঘাড় ফিরাইয়া চাহিল। ইন্সপেক্টর ডায়েরি বন্ধ করিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশ! তুমি কোত্থেকে?’

ব্যোমকেশ তাঁহার হাতে হাত মিলাইল‌, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিল না; আমার সহিত পরিচয় করাইয়া দিল। জানিতে পারিলাম‌, ইহার নাম অতুলকৃষ্ণ রায়‌, সংক্ষেপে এ কে রে। কলেজে ব্যোমকেশের সহাধ্যায়ী ছিলেন‌, এখন কলিকাতায় আছেন। আমার সহিত ইতিপূর্বে দেখা না হইলেও ব্যোমকেশের সহিত কলে-ভদ্রে দেখাশোনা হয়। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম‌, খুব আমুদে লোক‌, কিন্তু কাজের সময় গম্ভীর ও মিতভাষী।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ব্যাপার কি? শুনলাম একটি মেয়ের মৃত্যু হয়েছে!’

‘হ্যাঁ।’ কিছুক্ষণ নত-চক্ষে চিন্তা করিয়া এ কে রে বলিলেন‌, ‘এস‌, তোমাকে বলছি।’

আমরা দল হইতে একটু দূরে সরিয়া গিয়া দাঁড়াইলাম‌, এ কে রে অল্প কথায় ঘটনা বিবৃত করিলেন।–তিনি এখন এই এলাকার থানার দারোগা। আজ সন্ধ্যা সাতটা বাজিতে দশ মিনিটে তিনি টেলিফোনে খবর পান যে‌, সন্তোষবাবুর বাড়িতে একটি অপঘাত মৃত্যু ঘটিয়াছে; ফোন করিয়াছিলেন। সেক্রেটারি রবিবর্মার্ণ। এ কে রে তৎক্ষণাৎ লোকজন লইয়া উপস্থিত হইলেন। বাড়ির পশ্চিমদিকে‌, যেদিকে ভারা বাঁধা হয় নাই‌, সেইদিকে বাড়ির ঠিক ভিতের কাছে মৃত্যু যুবতীর দেহ পাওয়া গিয়াছে। এ কে রে পুলিস ডাক্তারকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন‌, ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন‌, উচ্চ স্থান হইতে পতনের ফলে ঘাড়ের কশেরু ভাঙিয়া মৃত্যু হইয়াছে‌, মৃত্যুর কাল অনুমান একঘন্টা আগে‌, অর্থাৎ সাড়ে ছাঁটার সময়। এ কে রে তখন তিনতলার খোলা ছাদে গিয়া দেখিলেন‌, ছাদের মাঝখানে একটি ছোট মাদুরের আসন পাতা রহিয়াছে‌, তার পাশে এক জোড়া মেয়েলি চপ্পল। খবর লইয়া তিনি জানিতে পারিলেন যে‌, মেয়েটি প্রত্যহ সূৰ্য্যস্তের সময় ছাদে আসিয়া বসিত। সন্দেহ রহিল না যে আজও মেয়েটি ছাদে গিয়াছিল এবং ছাদ হইতে পড়িয়া মরিয়াছে।

বিবৃতি শেষ করিয়া এ কে রে পুনশ্চ প্রশ্ন করিলেন‌, ‘কিন্তু তোমাকে খবর দিল কে?’

ব্যোমকেশ নেংটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল‌, ‘ওই ছেলেটি। ওর নাম নেংটি দত্ত। ও আমার কাছে যাতায়াত করে। বোধহয় ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে ফোন করেছিল।’

0 Shares