ব্যোমকেশ একটু অপ্রস্তুতভাবে গলা-ঝাড়া দিয়া বলিল, ‘অনাহূত অতিথি বলতে পারেন। আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী, ইনি আমার বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের আপনি চেনেন না, কিন্তু নেংটি—‘
সন্তোষবাবু বলিলেন, না চিনলেও নাম জানি। নেংটি আপনাদের ডেকে এনেছে? তিনি নেংটির দিকে চক্ষু ফিরাইলেন।
নেংটি পিছনে দাঁড়াইয়াছিল, শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল, ‘আমি-মাসিমা খুব ভয় পেয়েছিলেন—’
‘বেশ করেছ তুমি ব্যোমকেশবাবুকে খবর দিয়েছ। বিপদের সময় বন্ধুর কথাই আগে মনে পড়ে।’ তাঁহার কণ্ঠস্বরে প্রসন্নতার আভাস পাওয়া গেল, তিনি ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘নেংটি বুঝি আপনার বন্ধু?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বলতে পারেন।’
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘ভাল ভাল।’ এ কে রে’কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘আপনার কাজ কি শেষ হয়েছে?’
এ কে রে বলিলেন, ‘আর সব কাজই শেষ হয়েছে, লাশ চালান দিয়েই আমরা চলে যাব।’
কথাটা বোধহয় সন্তোষবাবুর মনে আসে নাই, তিনি থমকিয়া বলিলেন, ‘ঠিক তো। পোস্ট-মর্টেম করতে হবে।’ তিনি একবার চকিতের জন্য মৃতদেহের পানে দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিলেন, ‘আমার কিছু বলবার নেই, আপনার যা কর্তব্য তাই করুন।’
তিনি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াইলে এ কে রে বলিলেন, ‘যদি আপত্তি না থাকে, আপনাকে দুচারটে প্রশ্ন করতে চাই।’
সন্তোষবাবু থামিয়া গিয়া বলিলেন, ‘আপত্তি কিসের? আপনারা বসুন, আমি এখনি আসছি। রবি, এঁদের খাবার-ঘরে বসাও। আর চিংড়ি, তুমি এঁদের জন্যে চা-জলখাবারের ব্যবস্থা কর।’
তিনি উপরে চলিয়া গেলেন। রবিবামী সামনে আসিয়া বলিল, ‘আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।’
এ কে রে একজন অফিসারকে মৃতদেহের কাছে দাঁড় করাইয়া রবিবর্মার অনুসরণ করিলেন, আমরাও তাঁহার সঙ্গে চলিলাম।
পাঠকের সুবিধার জন্য এইখানে বাড়ির একটি প্ল্যান দেওয়া হইল।
সন্তোষবাবুর ভোজন-কক্ষটি বেশ বড়, লম্বা টেবিলে বারো-চৌদ্দ জন একসঙ্গে বসিয়া আহার করিতে পারে। আমরা গিয়া চেয়ারগুলিতে উপবিষ্ট হইলাম। লক্ষ্য করিলাম, যুগলচাঁদ, নেংটি ও চিংড়ি আমাদের সঙ্গে আসে নাই। রবিবর্মা বসিল না, কর্তার আগমনের প্রতীক্ষ্ণয় দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল।
এ কে রে’র পাশের চেয়ারে ব্যোমকেশ বসিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিল, ‘হেন মল্লিকের ঘরটা দেখেছি নাকি?’
এ কে রে বলিলেন, ‘মোটামুটি দেখেছি! অতি সাধারণ একটা শোবার ঘর। আসবাবপত্রও বেশি কিছু নেই।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চিঠিপত্র?’
এ কে রে বলিলেন, ‘এখনও ভাল করে দেখা হয়নি। যাবার আগে আর একবার দেখে যাব। তুমি দেখবে?
‘দেখব।’
এই সময় যে অফিসারটি লাশ পাহারা দিতেছিল, সে আসিয়া এ কে রোর কানের কাছে খাটো গলায় বলিল, ‘ভ্যান এসেছে, লাশ রওনা করে দেব?
এ কে রে বলিলেন, ‘দাও।’
অফিসার চলিয়া গেল। আমরা নিস্তব্ধ বসিয়া রহিলাম। খোলা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রবিবর্মা হল-ঘরের দিকে অপলক চাহিয়া ছিল, আমরা তাহার চক্ষু দিয়াই যেন মৃতদেহ স্থানান্তরণের কার্যটা দেখিতে পাইলাম। ক্ষণেকের জন্য তাহারা মঙ্গোলীয় চোখে একটা ক্ষুধিত অতৃপ্ত লালসা দেখা দিয়াই মিলাইয়া গেল। এই পলিকের দৃষ্টি জানাইয়া দিয়া গেল, সেক্রেটারি রবিবর্মার মন হেনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ছিল না।
২
তারপর সন্তোষবাবু আসিয়া টেবিলের শীর্ষস্থিত চেয়ারে বসিলেন। তিনি শৌখিন কেশ-বাস ত্যাগ করিয়া মামুলি আটপৌরে জাম-কাপড় পরিয়াছেন। উপবেশন করিয়া বলিলেন, ‘রবি, সিগারেট নিয়ে এস।’
রবিবর্মা তাড়াতাড়ি সিগারেট আনিতে গেল, সন্তোষবাবু এ কে রে’র পানে চাহিয়া বলিলেন, ‘আপনি বোধহয় হেনা সম্বন্ধে আমাকে প্রশ্ন করতে চান? দুঃখের বিষয়, তার কথা আমি বিশেষ কিছু জানি না। মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু তাকে ভাল করে জানিবার সুযোগ হয়নি। একে তো আমি বাড়িতে কম থাকি, তাছাড়া হেনাও খুব মিশুকে মেয়ে ছিল না। যাহোক—‘
রবিবর্মা সিগারেটের কৌটা ও দেশলাই আনিয়া সন্তোষবাবুর সম্মুখে রাখিল, তিনি কৌটার ঢাকা খুলিয়া আমাদের সম্মুখে ধরিলেন—’আসুন।’ সিগারেট লাইতে লইতে ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া বলিল, ‘শুনেছিলাম এ বাড়িতে ধূমপান নিষিদ্ধ।’
সন্তোষবাবু ঈষৎ ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, ‘আপনাদের জন্যে নিষিদ্ধ নয়।’ তিনি নিজে একটা সিগারেট মুখে দিলেন, দেশলাই জ্বলিয়া আমাদের দিকে বাড়াইয়া দিলেন।
‘এবার কি প্রশ্ন করবেন করুন।’
এ কে রে রাইটার জমাদারকে ইশারা করিলেন, সে খাতা-পেন্সিল বাহির করিল। তখন প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হইল।
প্রশ্ন : হেনার বাবার নাম কি?
উত্তর : কমল মল্লিক।
প্রশ্ন : কমল মল্লিক আপনার বন্ধু ছিলেন?
উত্তর : হ্যাঁ। তাঁকে প্রায় পনেরো বছর ধরে চিনতাম। ব্যবসার সূত্রে আমাকে ভারতবর্ষের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে হত, এখনো হয়। কমল মল্লিকের সঙ্গে ঢাকায় জানাশোনা হয়েছিল, তারপর ক্রমে ঘনিষ্ঠতা হয়।
প্রশ্ন : তাহলে হেন কলকাতায় আসবার আগেও তাকে দেখেছেন?
উত্তর; অনেক বার। ওর তিন-চার বছর বয়স থেকে ওকে দেখছি।
প্রশ্ন; ওকে আশ্রয় দেবার ফলে বাড়িতে কোন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল কি?
একটু থমকিয়া গিয়া সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘আমার স্ত্রী অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর শুচিবাই আছে; হেনা পাকিস্তানের মেয়ে, তার আচার-বিচার নেই, এই অছিলায় তিনি হেনাকে নিজের হাঁড়ি-হেঁশেল থেকে খেতে দিতে অসম্মত হয়েছিলেন। কাছেই একটা হোটেল আছে, সেখান থেকে হেনার খাবার আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।’